মলাট বৃত্তান্ত

চিঠি এলো বয়স গেল!

 সত্যজিৎ বিশ্বাস 
১৯ অক্টোবর ২০২২, ০৬:০৭ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

‘ও ঠাকুমা, ওঠো। উঠে বসে দেখো, তোমার নামে চিঠি এসেছে।’ লীনা, লোপা নাচতে নাচতে ঘরে ঢোকে। দুই নাতনির ঠেলা-ধাক্কায় কোঁকাতে কোঁকাতে মাজা ধরে উঠে বসে রেনুবালা। মুখ গম্ভীর করে বলেন, ‘বুড়ো মানুষের সঙ্গে এমন করে ফাজলামি, ইয়ার্কি যে করতে হয় না, এসব কী তোদের মা-বাবা শেখায়নি?’ 
‘তোমার সঙ্গে ফাজলামি করতে যাব কেন? সত্যি তোমার নামে ডাকে চিঠি এসেছে একটা।’ হাত নাচিয়ে হƒষ্টপুষ্ট চিঠির হলুদ খামটা দেখায় লীনা। 
লোপা তার ঠাকুমার চোখে চশমা পরিয়ে দিয়ে বলে, ‘দেখেছ খামের ওপরে কী লেখা?’ 
রেনুবালা অণুবীক্ষণ যন্ত্রে তাকানোর মতো করে দেখেন, খামের একেবারে ওপরে লেখা জরুরি প্রাপকের জায়গায় গোটা গোটা হরফে লেখাÑরেনুবালা সরকার।
এই ডিজিটাল যুগে, এই বয়সের রেনুবালাকে কে লিখল চিঠি? চিঠিটাকে ঘিরে বসে তিনজনের মনেই সমান কৌতূহল শুরু হলো! আর থাকতে না পেরে লোপা বলল, ‘ঠাকুমা, এ বয়সে নিশ্চয়ই তোমার কোনো প্রেমিক তোমাকে প্রেমপত্র দেবে না, খামটা খুলি?’ 
রেনুবালা কিছু বলার আগেই তার প্রতিনিধি হয়ে লীনা বলল, ‘আরে খোল তো। ঠাকুমা কি পর? আমরা তাকে সাহায্য না করলে কে করবে?’ 
রেনুবালা ফোকলা দাঁতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ায়। খাম খোলার পর বের হয়ে আসে দুটি জিনিস। একটা চিঠি, আরেকটা নীল কাগজে ভাঁজ করা চিঠির সাইজের প্যাকেট।  
‘কোনটা আগে খুলব? চিঠি না প্যাকেটটা?’ লোপা বোনের দিকে তাকায়। 
‘প্যাকেটাই খোল। চিঠিটাতে তো শুধু শব্দই থাকবে।’ লীনা উত্তর দেয়।
দুই বোন প্যাকেট খুলে চ্যাপ্টা গোলাপ ফুল দেখে কুল হয়ে যায়। চোখ বড় বড় করে তাকায় ঠাকুমার দিকে, ‘ঘটনা কী ঠাকুমা? চিঠিটা তো তাহলে পড়তেই হয়।’  
রেনুবালা কিছু বলার আগেই আবারও তার প্রতিনিধি হয়ে ওঠে লীনা, ‘আরে পড় তো। ঠাকুমা কি পর? আমরা তাকে সাহায্য না করলে কে করবে?’
চোখ বড় বড় করে পড়তে শুরু করে লোপা। 
প্রিয় রেনু, 
পত্র পাইয়া অবাক হইয়াছো নিশ্চয়ই। ভাবিতেছ, তোমাকে পত্র দেয়, অত্র এলাকায় এমন সাহস কার? কথা অবশ্য সত্য। তোমার যে ডাকু ভাই, সে তো কেবল তোমারই ভাই নহে, অত্র মহল্লারও ভাই। তাহার ভাইগিরির যন্ত্রণায় তোমার দিকে উঁকি দিবার ঝুঁকি নেবে এমন বুকের পাটা কার আছে? কে বলিবে, রেনুবালা সরকার, বিয়ে একটা দরকার।
প্রিয় রেনু, বিশ্বাস করো, আমার আছে। আমি বলিব। আমাকে চিনিতে পারিয়াছ কি? মনে আছে, গত হপ্তায় আমাদের ইস্কুলে একজন ম্যাজিশিয়ান আসিল জাদু দেখাইতে। তুমি দুই বেণি দোলাইতে দোলাইতে সহপাঠীদের পাশে বসিয়া জাদু দেখিতে লাগিলে। আর আমি তোমার চেহারাতেই জাদু দেখিতে লাগিলাম। এক সময় আর থাকিতে না পারিয়া আমার সহপাঠীদের ছাড়িয়া তোমার পাশে বসিবার অনুমতি চাইলাম। অথচ তুমি আমার সহিত কি নিষ্ঠুর আচরণটাই না করিলে! ওগো রেনু, সেদিন আমাকে অমন করিয়া কেনু মারিয়া উঠাইয়া না দিলেও পারিতে। যাই হোক, আমি সেই কেনু খাওয়া হারাধন।
তুমি কি জানো, তোমার কেনু খাইয়া এ হƒদয়ে রামধেনুর উৎপত্তি হইয়াছে! খাইতে বসিলে কোনো মেন্যু ভালো লাগে না। টেনুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেও ভালো লাগে না। মনের ভেতর শুধু ঘণ্টা বাজেÑরেনু, রেনু, রেনু। তোমার জবাব পাইবার আশায় আগামীকল্য স্কুল শেষে পুকুরপাড়ে বসিয়া থাকিব। বাকিটা তোমার ইচ্ছা। তবে একটা কথা মনে রাখিও, আমি হাল ছাড়িব না। এ খামের ডাকটিকিটখানা দেখো। নিজ গন্তব্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত যেইরূপ খামের সঙ্গেই লাগিয়া থাকে, তোমার পিছনে আমিও সেইরূপ লাগিয়া থাকিব।
ইতি
তোমারই হারু 
বিঃ দ্রঃ আমার বাগানের তাজা গোলাপ ফুটিয়াছে। পাঠাইলাম। 
চিঠি পড়া শেষ করে লোপা চিঠির তারিখের দিকে তাকায়। চার যুগ আগের চিঠি!
‘ও ঠাকুমা, বলো না, হারাধন কে?’ 
রেনুবালার চোখ কিশোরীদের মতো ছলছল করে ওঠে, ‘হারাধন কে, তা তো চিঠি পড়েই বুঝলি। আহারে বেচারা, সেই জন্যই বুঝি স্কুলে যাবার পথে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত!’
‘উনি কোথায় থাকেন? কী করেন এখন?’
ফোকলা দাঁতি রেনুবালা হাসতে হাসতে বলেন, ‘কী করে বলব, বল? এখনো হাল ধরে রেখেছে নাকি পরপারে পাল তুলেছে, জানব কী করে? তাও তো ভালো, এ চিঠির কল্যাণে মরার আগে জেনে গেলাম, একজন অন্তত ভালোবাসত আমায়।’

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন