সিএনজির চাকায় লিটন মিয়ার দুই দশকের জীবন

 মনোজ সরকার 
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:১৮ এএম  |  অনলাইন সংস্করণ

আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা। আয়তনের তুলনায় অনেক বেশি মানুষের বসবাস ছোট্ট এই শহরে। গণপরিবহণ ও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও বেশি। ফলে যানজট যেন নিত্যসঙ্গী নগরবাসীর। এছাড়া অলিগলি ও রাস্তাঘাটের যেন শেষ নেই ঢাকা শহরে। আবার এমন এলাকা, মহল্লা ও রাস্তার নাম রয়েছে- যা আমরা শুনিনি।

তবে ঢাকা শহরের রাস্তা, অলিগলি ও মহল্লার সবটাই চেনেন লিটন মিয়া। নতুন করে গড়ে উঠা ঢাকার বর্ধিতাংশ এখনো চিনে উঠতে পারেননি তিনি। যদিও তিনি জানেন কখন কোন সড়কে বা রাস্তায় যানজট হয়। তিনি এটাও জানেন কীভাবে যানজট এড়িয়ে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছানো যায়।

লিটন মিয়া পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক। ২০ বছর ধরে তিনি সিএনজি চালাচ্ছেন। ২০০২ সালে সিএনজিচালিত অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়ার পর থেকে শুরু- এখনো সিএনজি চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

রাত ৮টা, গাবতলীতে তখন যানজট। গাবতলী থেকে বাড্ডা মেরুল যাওয়ার জন্য ভাড়া জানতে চাইলে লিটন মিয়া বললেন- ‘অন্য সিএনজি যা নেবে, তার থেকে আমাকে ২০ টাকা কম দেবেন। সবার আগে পৌঁছে যাবেন।’ কিছুটা কৌতূহল হলো। তার সিএনজিতে সওয়ারি হয়ে জানতে চাইলাম টাকা কম ও আগে পৌঁছানোর রহস্য।

তিনি জানালেন, সিএনজি চালাতে চালাতে জানা হয়ে গেছে কখন কোথায় যানজট হয়। এজন্য তিনি গন্তব্যে পৌঁছাতে এমন রুট নির্বাচন করেন যেখানে যানজট কম হয়। ঢাকার সব অলিগলি চেনা থাকায় তার কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। এজন্য অন্য সিএনজিচালক জ্যামে বসে থাকে; তাদের সময় নষ্ট হয়। ফলে তাদের আয়ও কমে যায়। তাকে জ্যামে বেশি সময় নষ্ট হয় না। ফলে টাকা একটু কম নিলেও তার তেমন ক্ষতি হয় না।

কথায় কথায় লিটন মিয়া জানালেন- তিনি ২০ বছর ধরে সিএনজি চালাচ্ছেন। তার আগে বেবিট্যাক্সি চালাতেন। জানালেন তার জীবনের ভাঙা ভাঙা কিছু কথা।

লিটন মিয়ার বাড়ি সুনামগঞ্জের সদর থানায়। বাবা মো. খোরশেদ আলী শেখ একজন কৃষক। লিটন মিয়া ১৯৮২ সালে জন্মগ্রহণ করেন সুনামগঞ্জে। সেখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর আর পড়তে পারেননি তিনি। জীবিকার জন্য জন্মভূমি ছেড়ে পাড়ি দেন রাজধানী ঢাকায়। কিছুদিন ঘোরাফেরার পর ১৯৯৯ সালে বেবিট্যাক্সি চালানো শুরু করেন। কিনে ফেলেন নিজের একটি বেবিট্যাক্সি।

২০০২ সাল পর্যন্ত নিজের বেবিট্যাক্সি চালান লিটন মিয়া। এরপর পরিবেশ দূষণের ঘেরাটোপে নিজের বেবিট্যাক্সি বিক্রি করে দেন। অবশ্য ২০০৩ সালে ঢাকায় টু-স্ট্রোক বেবিট্যাক্সি চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০২ সালে সিএনজিচালিত অটোরিকশার নিবন্ধন দেওয়া শুরু হয়। সেই সময় থেকেই তিনি ভাড়ায় সিএনজি চালানো শুরু করেন।

এখন প্রতিদিন কত টাকা আয় হয়? জানতে চাইলে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি তিনি। মালিককে ভাড়া পরিশোধের পর যা থাকে তাতে চলে যায় বলে জানান লিটন মিয়া। প্রতিদিন কত টাকা ভাড়া পরিশোধ করতে হয় জানতে চাইলে বলেন- ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা। একেক গ্যারেজে একেক রকম।

সিএনজি চালাতে গিয়ে কোথাও সমস্যায় পড়েছের কিনা- জানতে চাইলে বলেন, ছোটখাটো সমস্যা লেগেই থাকে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে চাননি। তবে একবার ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছিলেন বলে জানান লিটন মিয়া। তখন নিজের বুদ্ধিমত্তায় বেঁচে যান তিনি। তিনি বলেন- একবার যাত্রাবাড়ী থেকে তিন যাত্রী উঠেছিলেন তার সিএনজিতে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘোরার পর বাইরে যেতে যান। অনেক টাকা অফারও করেছিলেন তারা। তাদের হাবভাব-আর চালচলনে বুঝে গিয়েছিলেন তারা ছিনতাইকারী। আর তাই তিনি কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে হঠাৎ স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে জানান তার সিএনজি নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানে আরও অনেক সিএনজিচালক ছিলেন। তারাও বুঝে গিয়েছিলেন বিষয়টি। এভাবে সেই যাত্রায় বেঁচে যান তিনি।

সংসার জীবনে লিটন মিয়ার ৪ সন্তান; ৩ মেয়ে ১ ছেলে। বড় মেয়ের বয়স ১২ বছর। করোনার কারণে লিটন মিয়া বেকার হয়ে গেলে বড় মেয়ের লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়। তখন অনেক টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ছেলের বয়স ৯ বছর; লেখাপড়া করছে। ২ মেয়ে ছোট।

দিনে দিনে মানুষ বাড়ছে ঢাকা শহরে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নগরীর পরিধি। আর সিএনজির চাকার মতো চলছে লিটন মিয়াদের জীবন।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন