বন্ধ্যত্ব নিয়ে জেনে নিন গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য

 ডা. নাসরীন সুলতানা রুমী 
২০ অক্টোবর ২০২২, ০৮:০৯ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

বন্ধ্যত্ব বা ইনফার্টিলিটি বর্তমান সময়ের জন্য একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসুন জেনে নিই কেন এটি নারী বা পুরুষের হয়? এর চিকিৎসায় করণীয় কী? এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টারের ইনফার্টিলিটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. নাসরীন সুলতানা রুমী 

বন্ধ্যত্ব বা ইনফার্টিলিটি কী? 

কোন একজন দম্পতি যদি দেখা যায় যে, ১ বছর তারা একসঙ্গে থাকছেন এবং কোনো ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি ছাড়াই থাকার পরেও তাদের প্রেগনেন্সি বা গর্ভধারণ হচ্ছে না। তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা তাকে বন্ধ্যা দম্পতি বা ইনফার্টাইল কাপল হিসাবে সংজ্ঞায়িত করি। 

চিকিৎসা যেভাবে শুরু হয় যেভাবে

চিকিৎসার যে প্রথম শুরু সেটা হচ্ছে, আমরা চেষ্টা করি, কারণটা খুঁজে বের করার জন্য। কারণ খুঁজতে গিয়ে, যেটা করি যে, যেই দম্পতি আসে, তাদের আমরা বিস্তারিত একটা হিস্ট্রি (ইতিহাস) নেই। তো এই হিসট্রি বা ইতিহাস নেয়ার মধ্যে তার স্বাস্থ্যগত বিষটাই বেশি জোর দেই। এবং তার মাসিকের কোনো সমস্যা আছে কি-না। তার পূর্বের গর্ভের কোনো ইতিহাস আছে কি-না এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছু ল্যাবরেটরি পরীক্ষা বা ইনভেস্টিগেশন বা আল্ট্রাসনোগ্রাম ইত্যাদি পরীক্ষাগুলো করে থাকি। কিছু হরমোন পরীক্ষাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে করে থাকি। এই বিষয়গুলো হওয়ার পরে এই যে আমরা একটা কাপলের সঙ্গেকথা বলি অথবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেই। তাহলে এক ধরনের কাউন্সিলিং হয়। যে কাউন্সিলিং এর ফলে একটা মেয়ে আমার কাছ থেকে এই তথ্যগুলো পায় যে, সে মাসিকটা রেগুলার কি-না তার, মাসিকের কোন সময় তারা একসঙ্গে থাকলে প্রেগনেন্সি বা অন্তঃসত্ত্বা হতে পারে। অথবা কী কারণের জন্য তার সমস্যা হচ্ছে, তো এইসব জেনে যাওয়ার ফলেও কিন্তু, দেখা যায় যে, প্রেগনেন্সি আসাটা অনেক তাড়াতাড়ি চলে আসার একটা সম্ভাবনা হয়। তো আলটিমেটলি আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পরে একটা কারণ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি।

বন্ধ্যাত্ব কেন হয়?

আমরা মনে করি অনেক সময় যে, একটা মহিলার কারণেই কিন্তু, বন্ধ্যাত্ব হয়। কিন্তু বিষয়টা একদমই আমরা যদি বৈজ্ঞানিকভাবে বলি, যে আসলে কিন্তু একেবারেই ভিন্নরূপ। পুরুষ এবং মহিলা ফিফটি ফিফটি পার্সেন্ট ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে তাদের বেশিরভাগ কারণ যে তাদের প্রেগনেন্সি হচ্ছে না। 

মেয়েরা কেন বন্ধ্যা হয়?

নারীদের ক্ষেত্রে ইউটেরাস, আর দুইপাশে দুইটা ওভারি থাকে এবং দুইটা টিউব থাকে। তো প্রত্যেক মাসে একটা করে ওভাম বা ডিম্বানু আসে। সেই ডিম্বানুটা টিউব দিয়ে চলে এসে একটা প্রেগনেন্সি হবে তখনই যদি হাজবেন্ডের কাছ থেকে স্পার্ম (বীর্য) আসে এবং সে স্পার্ম এবং ওভাম দুইটা মিলিত হয়ে একটা বাচ্চা তৈরি হয়। তো এই যে নরমাল প্রোসেস, এই প্রোসেসে কোথায় সমস্যা হয়? দেখা যায় কোন কারণে, ওভামটা আসছে না। যে ডিম্বানু আসার কথা প্রতি মাসে, সেটা আসছে না।  এই সমস্যাটাই এখন সবচেয়ে বেশি পেয়ে থাকি। 

অথবা দেখা যায় যে এই টিউবটার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে না। কোথাও ব্লক আছে। অথবা যেই ইউট্রাসের মধ্যে বাচ্চাটা বসবে, যে কনসিভ হবে সেখানে কোন এমন একটা কিছু আছে, যে একটা টিউমার আছে, অথবা এন্ড্রোমেনট্রসিস আছে, যার কারণে প্রেগনেন্সিটা বসতে পারছে না।

ছেলেরা কেন বন্ধ্যা হয়?

ছেলেদের ক্ষেত্রে যেটা আমরা বেশিরভাগ পাই, যে আমরা একটা টেস্ট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেজলাইন হিসাবে করে থাকি সেটা হচ্ছে সিমেন এনালাইসিস (বীর্য বিশ্লেষণ) । 
সিমেন পরীক্ষায় দেখা যায় যে, যে পরিমাণ শুক্রাণু একটা বাচ্চা হওয়ার জন্য দরকার হয়তো সেই সংখ্যাটা কম। 
অথবা দেখা যায় যে, শুক্রাণুটার নড়াচড়া করার কথা সেখানে সে হয়তো নড়ছে না, সে যে পরিমাণ নড়ার কথা। অথবা দেখা যায় যে, শুক্রাণুর আকার আকৃতি ভিন্নরকম। যেটাতে প্রেগনেন্সি হওয়ার জন্য দরকার, সেরকম না, কিন্তু অন্য ধরনের। তো এই ধরনের কিছু ক্রাইটারিয়া, আমরা এই ধরনের কিছু কারণের জন্য দেখা যায় যে প্রেগনেন্সি আসতে সমস্যা হয়। তো আমরা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে, এই কারণগুলা চিহ্নিত করে, আমরা স্পেসিফিক কোন কারণের জন্য প্রেগনেন্সি হচ্ছে না, আমরা প্রথমেই তার একটু কাউন্সিলিং করি।
বন্ধ্যাত্বের কারণ কী?
পলিসিস্টিক ওভারিসিন্ড্রম নামে একটা ডিজিজ আছে, যেই রোগের কারণে সময় মতো ডিম্বাণ ফুটে না। এই রোগটা বেশিরভাগ হয় যে, আমাদের এখন যে লাইফস্টাইল, একটু বসে বেশি থাকা, বসে পড়া, বসে কাজ করা ইত্যাদি কারণে। 
এজন্য মেয়েদের আমরা পরামর্শ দিই বেশি করে এক্সারসাইজ করার। ওজন ঠিক রাখার জন্য ডায়েটিং করতে হবে। এর ফলে ওবোলেশন বা ডিম্বাণু ঠিকমতো ফুটে। 

চিকিৎসা যেভাবে করা হয়

এই চিকিৎসার আবার কয়েকটা ধাপ আছে। প্রাথমিক ধাপে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কারণ খুঁজে বের করি। এবং প্রাথমিক কিছু ওষুধপত্র দিয়ে থাকি। সেই ওষুধপত্রগুলো বেশিরভাগক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, এই ডিম্বাণু ফুটানোর জন্য। সেটা ট্যাবলেট আকারে কিংবা ইঞ্জেকশন আকারে দেওয়া হয়।
এগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা। 
প্রাথমিক চিকিৎসার তিন থেকে ছয় মাসেও যদি গর্ভধারণ না হয় তাহলে অপারেটিভ প্রসিডিউর বা দ্বিতীয় ধাপের চিকিৎসা দেওয়া হয়। 

ল্যাপরোস্কপিক ড্রিলিং অথবা ল্যাপরোস্কপিক সিস্টেকটমি অথবা হিস্টোস্কপিক এক্সামিনেশন এগুলা করে আমরা একই সঙ্গে কারণ খুঁজে বের করি এবং কোন কারণ যদি পাওয়া যায়, সেই সঙ্গে একই সেটিং-এ চিকিৎসাও দিয়ে থাকি। 

দ্বিতীয় ধাপের চিকিৎসায় কাজ না হলে তৃতীয় ধাপ বা শেষ ধাপের চিকিৎসা হিসেবে আর্টিফিসিয়াল বা টেস্টটিউব বেবি পদ্ধতি প্রয়োজন হয়। 

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জনই প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের চিকিৎসার মাধ্যমেই প্রেগনেন্সি বা গর্ভধারণে সফলতা অর্জন করেন।  ৯ থেকে ১০ পারসেন্ট নারীদের ক্ষেত্রে টেস্টটিউব বেবির চিকিৎসাটা লাগে। টেস্ট টিউব বেবির চিকিৎসা ব্যয়বহুল।  

বন্ধ্যত্ব চিকিৎসা কখন নিতে হবে?

বন্ধ্যত্ব বিষয়টা আমরা কখন চিকিৎসায় যাব? অনেকেই দেখা যায় যে, আমার কাছে আসে যখন, হয়তো ১০ বছর ১১ বছর হয়ে গেছে, কিন্তু ভাল চিকিৎসা নেয় নাই। এটা একটা। আবার কিছু কিছু আছে, যারা কি-না হয়তো এক জায়গায় ৬ মাস। কোন জায়গায় ৫ মাস। কোন জায়গায় ৩ মাস এইভাবে চিকিৎসা করে থাকেন। হয়তো কোনো কারণে সন্তোষজনক হচ্ছে না, অথবা সাকসেসফুল হচ্ছে না, সাকসেসফুল মানে তো প্রেগনেন্সি। প্রেগনেন্সি হচ্ছে না। দেখা যায় একটু ধৈর্য ধরতে হয়। ধৈর্য যেমন রাখতে হয়, তেমন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাটাও নিতে হয়।

লেখক: ডা. নাসরীন সুলতানা রুমী

বিভাগীয় প্রধান, ইনফার্টিলিটি, মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সেন্টার, ঢাকা

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন