পাখিপ্রাণ ইমরান ও বারামখানায় এক দুপুর
পুরো নাম ইমরান এইচ মণ্ডল। লোকে ডাকেন পাখিবাজ ইমরান, কেউ বলেন পাখিপ্রাণ ইমরান। এত বেশি পাখিপ্রেমী যে, এতদাঞ্চলে পাখির কথা উঠলেই তার নামটা আপনিতেই গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।
এমনিতেই সারা বছর লেগে থাকেন তিনি, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ এলে ব্যস্ততার আর শেষ থাকে না। কালবৈশাখী ঝড়ে যখন পাখির বাসাগুলো তছনছ হতে থাকে, তখন ইমরানের মনও এলোমেলো হয়ে যায়, দলবল সঙ্গে করে এক আশ্রম থেকে আরেক আশ্রমে ছুটতে থাকেন তিনি। গাছে গাছে নতুন করে হাঁড়ি লাগান, ছিটকে পড়া বাচ্চাদের পরম আদরে বাসায় তুলে দেন। আহত বাচ্চাদের শুশ্রূষা করেন, সুস্থ করে তোলেন।
এরপর বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেলে দম নেওয়ারও দম থাকে না আর। পাখিদের প্রতি এ মায়ার পেছনে তার কোনো হাত নেই, সহজভাবেই কেঁদে ওঠে তার হৃদয়। তিনি বলেন, ‘পাখির কষ্ট আমার সহ্য হয় না, আমি ওদেরকে ভালোবসি’।
শৈশব থেকেই পাখিবান্ধব তিনি। পাখিকে কেবল আলাদা করে যত্ন করেন এমন নয়! অন্যান্য প্রাণীদের প্রতিও তিনি সমান দরদ পুষে রাখেন। এমনকি পাড়ার লোকেরা যখন দলবেঁধে সাপ-সাপ রব তুলে মারতে উদ্যত হয়, তখনও তিনি হা হা করে ওঠেন-প্লিজ ওকে মারবেন না! ও তো নিরীহ প্রাণী! কে শোনে তার কথা! অগত্যা তিনি এই বলে বোঝাতেন যে, আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না! সব সাপ বিষাক্ত নয়, সবার দাঁতে বিষ থাকে না।
তাছাড়া ওরা তো আমাদের প্রতিবেশী, ওদেরও তো বাঁচার অধিকার আছে, ওরা উপকার করে। এরকম নাজুক কথায় কে কান দেবে! উল্টো আড়ালে আবডালে লোকে তাকে ক্ষ্যাপা বলত! কোনো নিন্দাতেই ইমনারকে অবশ্য থামানো যায়নি, তিলে তিলে বরং পশুপাখিদের প্রতি তার মায়া আরও বেড়ে গেছে। তারপর ডালপালা ছাড়িয়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।
গাইবান্ধা জেলার একবারে দক্ষিণের সীমানা ঘেঁষা বাইগুনি গ্রামে জন্ম নেওয়া ইমরান নিজ গ্রামের বাইরেও আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামেও ছড়িয়ে দিয়েছেন পাখির আবাস। বাইগুনির পরেই ছায়াঘেরা, নদী আশ্রিত, দিগন্ত বিস্তারি রূপবান এক গ্রাম গড়ফতেপুর। গ্রামের কোমর ধরে বয়ে বয়ে দক্ষিণে চলে গেছে সড়কিদহ।
দহের পাড় বেঁধে দুইতলা-তিনতলার মতো উঁচু করে, সেই উঁচুতে বানানো হয়েছে চৌচালা বারামখানা। চারপাশ থেকে গাছেদের ছায়া এসে পড়েছে বারামখানার মাথায়, পুবদিকে পা ছড়ালেই নদী, তারপর ওপারের পাথার, সোনালি সোনালি ক্ষেত লাফ দিয়ে দিয়ে চলে গেছে দূর থেকে আরও দূর। পশ্চিমে বাগান।
বিরল প্রজাতির পারুল থেকে নিয়ে ছোট বড় শৌখিন বৃক্ষাদি, লতানো গুল্মরাজি, নীলকণ্ঠের পাশে দুই-একটা মাধবিলতা আর ওদের ফাঁকে ফাঁকে হরেক বাহারি ফুলগাছ। গাছে গাছে ফুল ফুটে আছে- নীল, লাল, গোলাপি, হলুদ, মেরুন, সাদা, খয়েরি, গুড়ি গুড়ি বেগুনি...অনেক।
ফুলে প্রজাপতি পড়েছে, ওরা উড়ছে, নামছে, বসছে। পাখিদের কার্যক্রমটা উপরে গাছেদের ডালে ডালে। বারামখানাজুড়ে কিচিরমিচির শব্দ, ঝিম দুপুরে একটানা প্রকৃতির একটানা অচেনা এক গুঞ্জনে যেন মুখরিত হয়ে আছে পাখি-প্রজাপতিদের এ মচ্ছব-বারামখানা।
প্রতিবেশী চারুশিল্পী সজল আহমেদ বলতে গেলে এক রকম শৌখিন মেজাজেই গড়ে তুলেছেন প্রকৃতিসুলভ সৌন্দর্যের এই মহাফেজখানা। মূলত পাখিদের কথা ভেবেই বছর দুয়েক আগে সজলের সঙ্গে হাঁড়ি হাতে করে ইমরানও নেমে পড়েছিলেন বারামখানায়। প্রথম তিন মাসে পাখিরা এদিকে তেমন আসেইনি, কিন্তু এরপর আর চেয়ে থাকতে হয়নি! দোয়েল, শালিক, হলদিয়া, টিয়া, চড়ুই, বাবুই, বুলবুলি, তোতা-একের পর এক এসে এসে বাসা বেঁধেছে। ফলে পাখির কলকাকলি শুনতে, মোজা খুলে একটু হাওয়া নিতে, তেতো চোখ এই জল-পরানে চুবিয়ে নিতে, শান্তি-শান্তি ভাবের এই বারামখানাকে টার্গেট করে হরদম লোক আসছে, যাচ্ছে।
এখানেই প্রথমবারের মতো দেখা মিলল পাখিপ্রাণ ইমরানের, পাখিদের খোঁজখবর করতে প্রায়শই এদিকে চলে আসেন তিনি। বারামখানায় বসে বসে দেখে নেন পাখিদের চলাচল, ভালো-মন্দ। পরিচয় হতে যা দেরি, সহজ হতে সময় লাগল না, ইমরান নিজেই ঘুরে ঘুরে গাছেদের তলে তলে নিয়ে গিয়ে পাখিদের দেখাতে লাগলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে পাখিদের সংসার দেখি, উড়াউড়ি এবং আনন্দ দেখি। ইমরান আঙুলের ইশারায় জলাভুমির ওপারের পাটের আবাদ দেখান-ওই যে দেখুন, ওখানে একটা কাশবন ছিল, বন্যার সময় টুনটুনি পাখিরা বাসা করত, আফসোস মুখে তিনি আমার চোখের দিকে তাকান-আচ্ছা বলেন তো, ওরা এখন কোথায় যাবে! আমি কিছু বলি না, তার নাছোড় চোখে চেয়ে চোখ নামিয়ে নিই, সামনে যেতে থাকি। ইমরান থামেন না- এই যে মানুষ আবাদের কথা বলে, গাছ কে আগাছা নাম দিয়ে, এভাবে ঝোপ-ঝাঁড় জঙ্গল সাফ সাফাই করছে, মানুষ গ্রাম কেটে কেটে শহর বানাচ্ছে!
ভিটাবাস্তু গাছগাছালি সরিয়ে তর তর করে উঠে যাচ্ছে কেউটে পিচ!-এ রকম করতে থাকলে পাখিরা কোথায় যাবে! ইমরানের আহাজারির কাছে কি আর বলতে পারি, হ্যাঁ হু করে এগিয়ে যাই আরেক গাছের দিকে।
ইমরান বুঁদবুঁদ করে আরও কি কি যেন বলে যেতে থাকেন, সেদিকে আমার মন থাকে না। ভাবি- মানুষ যেভাবে সুবিধাবাদী হয়ে উঠছে, তাতে একদিন হয়ত সবুজ বলে কিছুই আর থাকবে না।
শহর কি এভাবেই একদিন গিলে নেবে গাঁওকে? অথচ গ্রাম একদা এক সহজ জনপদ ছিল। ধানকাটার গান, ধুয়া, মারফতি, যাত্রাপালা,পালাগান, কবিগান, পুঁথিপাঠ, কেচ্ছাকাহিনী, গীত-গজল জারি-সারি মুর্শিদীর টানে দুলে উঠত গ্রামজীবন।
আর এখন! অজগাঁওয়ে পিঠাপুলিও পানসে হয়ে আসছে। সরবতের পরিবর্তে কোলাকোলা দেয়া হয়। চা-চানাচুরের সঙ্গে ফাস্টফুট। ধকল শহর সহ্য করতে পারলেও গ্রাম পারে না। যারা নবান্নের গান করত, নছিমন, মনসাপালা কিংবা বোহেমিয়ান বাউলবেশে যারা গান করে বেড়াত এগ্রাম-ওগ্রাম, বাঁদর কাঁধে বাড়ি বাড়ি খেলা দেখিয়ে দু’চার আনা পেত তারাও যেন সরে যাচ্ছেন ভাগ বুঝে। একতারা, সারিন্দার জায়গায় চলে এসেছে সিডি-ভিসিডি।
আগে তবুও বাঁশের আঁড়া ছিল, এখন বাঁশের কাজ কমে গেছে! বাঁশ-খড়ের জায়গায় এখন এসেছে ইট বালি সিমেন্ট! এসেছে আলো ঝলমলো বৈদ্যুতিক বাতি! ফলে অন্ধকার নাই, জোনাকি নাই, জোছনা নাই, পাখিদের জন্য পতঙ্গ নাই! পাখিদের জায়গা তাই ছোট থেকে আরও ছোট হয়েছে-এ কথা সাধারণেরা বুঝবে কি করে!
তারা ব্যস্ত, তাদের বাড়িতে টেলিভিশন চলছে, গ্যাসের চুলা জ্বলছে, মোবাইলে নেট বইছে, কারও কারও রেফ্রিজারেটরে ঠাণ্ঠা হচ্ছে পুরনো খাবার-এতসব চালু রাখতে হলে তাদের তো দৌড়াতেই হবে! পাখি, পতঙ্গ, প্রজাপতি, সবুজ, প্রকৃতি, প্রতিবেশ, পরিবেশ নিয়ে আলাদা করে তাদের ভাবার বা দরদ দেখানোর দম কই! অথচ গ্রামকে মনে পড়লেই এখনও আমরা এক নিবিড় নদীবাহিত ছায়াভরা জনপদকেই দেখতে পাই।
গ্রাম-শহর নিয়ে কল্পনায় বেশি দূর যেতে পারি না, তার আগেই ইমরান গলা বাড়ান, চলেন ওই দিকে যাই। আমরা ফের উল্টো দিকে ফিরতে থাকি। দুপুর গড়িয়ে যায়। বারামখানার টাইলস বাঁধানো মেঝেতে কাঁত বসে থাকি, খুঁটিতে হেলান দেই। তারপর যে যার মতো আনমনা হয়ে যাই। অনেকক্ষণ কোনো কথা হয় না! এক নাগারে নিরাময়ী সবুজ দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকি। দূরে একটা ফিঙ্গে লেজ নাঁচিয়ে ফসলের মধ্যে ডুব দেয়।
আবাদের পরে মেঠো পথ, পথে গাঁওয়ালিরা হেঁটে যায়। সবাই ব্যস্ত। ইমরানদের কথা আলাদা, তাঁরা পারেন না! পশু-পাখির জন্য তাদের অফুরন্ত ভালোবাসা, পাখিদের কষ্টে তাদের মনে বেদনা হয়, পাখি নিহত হলে তারা কাঁদেন, অস্থির হয়ে পড়েন। পাখিকে বাঁচাতে হবে! ফুল পাখি জোনাকি এবং এই জোছনা ভেজা সবুজ বাংলা-তাকে তো রক্ষা করতে হবে! ইমরান একা কি করতে পারেন! তাছাড়া তার তো বিঘা-বিঘা জমি নেই যে, পাখিদের আশ্রম গড়ে দেবেন। কিন্তু থামলে তো চলবে না! স্বপ্ন, কেবল স্বপ্ন হাতে করেই ছুটে চলেছেন ইমরান, গড়ে তুলেছেন ‘পরিবেশ উন্নয়ন পরিবার’ নামের এক সংগঠন।
সেও তো প্রায় বছর সাতেক হলো। এখন বেশকিছু পাখিবন্ধুও জুটে গেছে, পরিধি বেড়েছে। চল্লিশ সদস্যের পরিবেশবান্ধব এ পরিবার পাখিসেবার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজেও হাত লাগিয়েছে। ইমরানের কাছ থেকে শোনা এসব গল্পগুলো পুরোপুরি ছবি করতে পারি না, তার আগেই তিনি বারামখানার মেঝে থেকে নেমে পড়েন, আলগোছে টিপে টিপে লাগোয়া আমগাছের তলায় চলে যান। উপরে তাকান।
বাতাসে দুটো শালিক ছানার একটানা চি চি আওয়াজ ভেসে আসে। হাঁড়ির মুখ থেকে বেরিয়ে আসা সদ্য চোখফোটা ছানাদের মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকেন তিনি। কী গভীর এক মমতায় তার চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। পাশে গিয়ে দাঁড়াই। তাকে দেখি। ছানা দুটো একটানা চি চি করতে থাকে। একটা আনন্দ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে।
পাখিপ্রাণ ইমরান ও বারামখানায় এক দুপুর
আজাদুর রহমান
২৬ মে ২০২১, ০১:৪০:০৯ | অনলাইন সংস্করণ
পুরো নাম ইমরান এইচ মণ্ডল। লোকে ডাকেন পাখিবাজ ইমরান, কেউ বলেন পাখিপ্রাণ ইমরান। এত বেশি পাখিপ্রেমী যে, এতদাঞ্চলে পাখির কথা উঠলেই তার নামটা আপনিতেই গল্পের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।
এমনিতেই সারা বছর লেগে থাকেন তিনি, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ এলে ব্যস্ততার আর শেষ থাকে না। কালবৈশাখী ঝড়ে যখন পাখির বাসাগুলো তছনছ হতে থাকে, তখন ইমরানের মনও এলোমেলো হয়ে যায়, দলবল সঙ্গে করে এক আশ্রম থেকে আরেক আশ্রমে ছুটতে থাকেন তিনি। গাছে গাছে নতুন করে হাঁড়ি লাগান, ছিটকে পড়া বাচ্চাদের পরম আদরে বাসায় তুলে দেন। আহত বাচ্চাদের শুশ্রূষা করেন, সুস্থ করে তোলেন।
এরপর বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেলে দম নেওয়ারও দম থাকে না আর। পাখিদের প্রতি এ মায়ার পেছনে তার কোনো হাত নেই, সহজভাবেই কেঁদে ওঠে তার হৃদয়। তিনি বলেন, ‘পাখির কষ্ট আমার সহ্য হয় না, আমি ওদেরকে ভালোবসি’।
শৈশব থেকেই পাখিবান্ধব তিনি। পাখিকে কেবল আলাদা করে যত্ন করেন এমন নয়! অন্যান্য প্রাণীদের প্রতিও তিনি সমান দরদ পুষে রাখেন। এমনকি পাড়ার লোকেরা যখন দলবেঁধে সাপ-সাপ রব তুলে মারতে উদ্যত হয়, তখনও তিনি হা হা করে ওঠেন-প্লিজ ওকে মারবেন না! ও তো নিরীহ প্রাণী! কে শোনে তার কথা! অগত্যা তিনি এই বলে বোঝাতেন যে, আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না! সব সাপ বিষাক্ত নয়, সবার দাঁতে বিষ থাকে না।
তাছাড়া ওরা তো আমাদের প্রতিবেশী, ওদেরও তো বাঁচার অধিকার আছে, ওরা উপকার করে। এরকম নাজুক কথায় কে কান দেবে! উল্টো আড়ালে আবডালে লোকে তাকে ক্ষ্যাপা বলত! কোনো নিন্দাতেই ইমনারকে অবশ্য থামানো যায়নি, তিলে তিলে বরং পশুপাখিদের প্রতি তার মায়া আরও বেড়ে গেছে। তারপর ডালপালা ছাড়িয়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।
গাইবান্ধা জেলার একবারে দক্ষিণের সীমানা ঘেঁষা বাইগুনি গ্রামে জন্ম নেওয়া ইমরান নিজ গ্রামের বাইরেও আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামেও ছড়িয়ে দিয়েছেন পাখির আবাস। বাইগুনির পরেই ছায়াঘেরা, নদী আশ্রিত, দিগন্ত বিস্তারি রূপবান এক গ্রাম গড়ফতেপুর। গ্রামের কোমর ধরে বয়ে বয়ে দক্ষিণে চলে গেছে সড়কিদহ।
দহের পাড় বেঁধে দুইতলা-তিনতলার মতো উঁচু করে, সেই উঁচুতে বানানো হয়েছে চৌচালা বারামখানা। চারপাশ থেকে গাছেদের ছায়া এসে পড়েছে বারামখানার মাথায়, পুবদিকে পা ছড়ালেই নদী, তারপর ওপারের পাথার, সোনালি সোনালি ক্ষেত লাফ দিয়ে দিয়ে চলে গেছে দূর থেকে আরও দূর। পশ্চিমে বাগান।
বিরল প্রজাতির পারুল থেকে নিয়ে ছোট বড় শৌখিন বৃক্ষাদি, লতানো গুল্মরাজি, নীলকণ্ঠের পাশে দুই-একটা মাধবিলতা আর ওদের ফাঁকে ফাঁকে হরেক বাহারি ফুলগাছ। গাছে গাছে ফুল ফুটে আছে- নীল, লাল, গোলাপি, হলুদ, মেরুন, সাদা, খয়েরি, গুড়ি গুড়ি বেগুনি...অনেক।
ফুলে প্রজাপতি পড়েছে, ওরা উড়ছে, নামছে, বসছে। পাখিদের কার্যক্রমটা উপরে গাছেদের ডালে ডালে। বারামখানাজুড়ে কিচিরমিচির শব্দ, ঝিম দুপুরে একটানা প্রকৃতির একটানা অচেনা এক গুঞ্জনে যেন মুখরিত হয়ে আছে পাখি-প্রজাপতিদের এ মচ্ছব-বারামখানা।
প্রতিবেশী চারুশিল্পী সজল আহমেদ বলতে গেলে এক রকম শৌখিন মেজাজেই গড়ে তুলেছেন প্রকৃতিসুলভ সৌন্দর্যের এই মহাফেজখানা। মূলত পাখিদের কথা ভেবেই বছর দুয়েক আগে সজলের সঙ্গে হাঁড়ি হাতে করে ইমরানও নেমে পড়েছিলেন বারামখানায়। প্রথম তিন মাসে পাখিরা এদিকে তেমন আসেইনি, কিন্তু এরপর আর চেয়ে থাকতে হয়নি! দোয়েল, শালিক, হলদিয়া, টিয়া, চড়ুই, বাবুই, বুলবুলি, তোতা-একের পর এক এসে এসে বাসা বেঁধেছে। ফলে পাখির কলকাকলি শুনতে, মোজা খুলে একটু হাওয়া নিতে, তেতো চোখ এই জল-পরানে চুবিয়ে নিতে, শান্তি-শান্তি ভাবের এই বারামখানাকে টার্গেট করে হরদম লোক আসছে, যাচ্ছে।
এখানেই প্রথমবারের মতো দেখা মিলল পাখিপ্রাণ ইমরানের, পাখিদের খোঁজখবর করতে প্রায়শই এদিকে চলে আসেন তিনি। বারামখানায় বসে বসে দেখে নেন পাখিদের চলাচল, ভালো-মন্দ। পরিচয় হতে যা দেরি, সহজ হতে সময় লাগল না, ইমরান নিজেই ঘুরে ঘুরে গাছেদের তলে তলে নিয়ে গিয়ে পাখিদের দেখাতে লাগলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে পাখিদের সংসার দেখি, উড়াউড়ি এবং আনন্দ দেখি। ইমরান আঙুলের ইশারায় জলাভুমির ওপারের পাটের আবাদ দেখান-ওই যে দেখুন, ওখানে একটা কাশবন ছিল, বন্যার সময় টুনটুনি পাখিরা বাসা করত, আফসোস মুখে তিনি আমার চোখের দিকে তাকান-আচ্ছা বলেন তো, ওরা এখন কোথায় যাবে! আমি কিছু বলি না, তার নাছোড় চোখে চেয়ে চোখ নামিয়ে নিই, সামনে যেতে থাকি। ইমরান থামেন না- এই যে মানুষ আবাদের কথা বলে, গাছ কে আগাছা নাম দিয়ে, এভাবে ঝোপ-ঝাঁড় জঙ্গল সাফ সাফাই করছে, মানুষ গ্রাম কেটে কেটে শহর বানাচ্ছে!
ভিটাবাস্তু গাছগাছালি সরিয়ে তর তর করে উঠে যাচ্ছে কেউটে পিচ!-এ রকম করতে থাকলে পাখিরা কোথায় যাবে! ইমরানের আহাজারির কাছে কি আর বলতে পারি, হ্যাঁ হু করে এগিয়ে যাই আরেক গাছের দিকে।
ইমরান বুঁদবুঁদ করে আরও কি কি যেন বলে যেতে থাকেন, সেদিকে আমার মন থাকে না। ভাবি- মানুষ যেভাবে সুবিধাবাদী হয়ে উঠছে, তাতে একদিন হয়ত সবুজ বলে কিছুই আর থাকবে না।
শহর কি এভাবেই একদিন গিলে নেবে গাঁওকে? অথচ গ্রাম একদা এক সহজ জনপদ ছিল। ধানকাটার গান, ধুয়া, মারফতি, যাত্রাপালা,পালাগান, কবিগান, পুঁথিপাঠ, কেচ্ছাকাহিনী, গীত-গজল জারি-সারি মুর্শিদীর টানে দুলে উঠত গ্রামজীবন।
আর এখন! অজগাঁওয়ে পিঠাপুলিও পানসে হয়ে আসছে। সরবতের পরিবর্তে কোলাকোলা দেয়া হয়। চা-চানাচুরের সঙ্গে ফাস্টফুট। ধকল শহর সহ্য করতে পারলেও গ্রাম পারে না। যারা নবান্নের গান করত, নছিমন, মনসাপালা কিংবা বোহেমিয়ান বাউলবেশে যারা গান করে বেড়াত এগ্রাম-ওগ্রাম, বাঁদর কাঁধে বাড়ি বাড়ি খেলা দেখিয়ে দু’চার আনা পেত তারাও যেন সরে যাচ্ছেন ভাগ বুঝে। একতারা, সারিন্দার জায়গায় চলে এসেছে সিডি-ভিসিডি।
আগে তবুও বাঁশের আঁড়া ছিল, এখন বাঁশের কাজ কমে গেছে! বাঁশ-খড়ের জায়গায় এখন এসেছে ইট বালি সিমেন্ট! এসেছে আলো ঝলমলো বৈদ্যুতিক বাতি! ফলে অন্ধকার নাই, জোনাকি নাই, জোছনা নাই, পাখিদের জন্য পতঙ্গ নাই! পাখিদের জায়গা তাই ছোট থেকে আরও ছোট হয়েছে-এ কথা সাধারণেরা বুঝবে কি করে!
তারা ব্যস্ত, তাদের বাড়িতে টেলিভিশন চলছে, গ্যাসের চুলা জ্বলছে, মোবাইলে নেট বইছে, কারও কারও রেফ্রিজারেটরে ঠাণ্ঠা হচ্ছে পুরনো খাবার-এতসব চালু রাখতে হলে তাদের তো দৌড়াতেই হবে! পাখি, পতঙ্গ, প্রজাপতি, সবুজ, প্রকৃতি, প্রতিবেশ, পরিবেশ নিয়ে আলাদা করে তাদের ভাবার বা দরদ দেখানোর দম কই! অথচ গ্রামকে মনে পড়লেই এখনও আমরা এক নিবিড় নদীবাহিত ছায়াভরা জনপদকেই দেখতে পাই।
গ্রাম-শহর নিয়ে কল্পনায় বেশি দূর যেতে পারি না, তার আগেই ইমরান গলা বাড়ান, চলেন ওই দিকে যাই। আমরা ফের উল্টো দিকে ফিরতে থাকি। দুপুর গড়িয়ে যায়। বারামখানার টাইলস বাঁধানো মেঝেতে কাঁত বসে থাকি, খুঁটিতে হেলান দেই। তারপর যে যার মতো আনমনা হয়ে যাই। অনেকক্ষণ কোনো কথা হয় না! এক নাগারে নিরাময়ী সবুজ দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকি। দূরে একটা ফিঙ্গে লেজ নাঁচিয়ে ফসলের মধ্যে ডুব দেয়।
আবাদের পরে মেঠো পথ, পথে গাঁওয়ালিরা হেঁটে যায়। সবাই ব্যস্ত। ইমরানদের কথা আলাদা, তাঁরা পারেন না! পশু-পাখির জন্য তাদের অফুরন্ত ভালোবাসা, পাখিদের কষ্টে তাদের মনে বেদনা হয়, পাখি নিহত হলে তারা কাঁদেন, অস্থির হয়ে পড়েন। পাখিকে বাঁচাতে হবে! ফুল পাখি জোনাকি এবং এই জোছনা ভেজা সবুজ বাংলা-তাকে তো রক্ষা করতে হবে! ইমরান একা কি করতে পারেন! তাছাড়া তার তো বিঘা-বিঘা জমি নেই যে, পাখিদের আশ্রম গড়ে দেবেন। কিন্তু থামলে তো চলবে না! স্বপ্ন, কেবল স্বপ্ন হাতে করেই ছুটে চলেছেন ইমরান, গড়ে তুলেছেন ‘পরিবেশ উন্নয়ন পরিবার’ নামের এক সংগঠন।
সেও তো প্রায় বছর সাতেক হলো। এখন বেশকিছু পাখিবন্ধুও জুটে গেছে, পরিধি বেড়েছে। চল্লিশ সদস্যের পরিবেশবান্ধব এ পরিবার পাখিসেবার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজেও হাত লাগিয়েছে। ইমরানের কাছ থেকে শোনা এসব গল্পগুলো পুরোপুরি ছবি করতে পারি না, তার আগেই তিনি বারামখানার মেঝে থেকে নেমে পড়েন, আলগোছে টিপে টিপে লাগোয়া আমগাছের তলায় চলে যান। উপরে তাকান।
বাতাসে দুটো শালিক ছানার একটানা চি চি আওয়াজ ভেসে আসে। হাঁড়ির মুখ থেকে বেরিয়ে আসা সদ্য চোখফোটা ছানাদের মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকেন তিনি। কী গভীর এক মমতায় তার চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। পাশে গিয়ে দাঁড়াই। তাকে দেখি। ছানা দুটো একটানা চি চি করতে থাকে। একটা আনন্দ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে।
সম্পাদক : সাইফুল আলম, প্রকাশক : সালমা ইসলাম
প্রকাশক কর্তৃক ক-২৪৪ প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড), বারিধারা, ঢাকা-১২২৯ থেকে প্রকাশিত এবং যমুনা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং লিঃ থেকে মুদ্রিত।
পিএবিএক্স : ৯৮২৪০৫৪-৬১, রিপোর্টিং : ৯৮২৩০৭৩, বিজ্ঞাপন : ৯৮২৪০৬২, ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৩, সার্কুলেশন : ৯৮২৪০৭২। ফ্যাক্স : ৯৮২৪০৬৬
E-mail: jugantor.mail@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Developed by The Daily Jugantor © 2024