‘আমরা আনুষ্ঠানিকতা ও প্রদর্শনবাদিতায় বেশি উৎসাহি হয়ে পড়ছি’

 জুননু রাইন 
১১ মার্চ ২০২১, ১১:২০ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

গোলাম কিবরিয়া পিনু, মূলত কবি। প্রবন্ধ, ছড়া ও অন্যান্য বিষয়েও লিখে থাকেন। গবেষণামূলক কাজেও যুত্ত। জন্ম ৩০ মার্চ ১৯৫৬ গাইবান্ধায়।

গাইবান্ধা শহরে মূলত  শৈশব-কৈশোর কেটেছে। গাইবান্ধা শহরের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্মান (বাংলাভাষা ও সাহিত্য) এবং স্নাতকোত্তর; পিএইচডি।

১৯৮৩ থেকে ধারাবাহিকভাবে ঢাকায় বসবাস করেন। লিখছেন তিন দশকের অধিককাল। এর মধ্যে কবিতা-ছড়া-প্রবন্ধ ও গবেষণা মিলে ২৭টি গ্রন্থ বের হয়েছে- বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে।

তিনি বহু ধরনের কবিতা লিখেছেন এবং সেগুলো বিভিন্ন নিরীক্ষাপ্রবণতায় সংশ্লিষ্ট। তার কবিতায় জীবন আছে, সমাজ আছে, প্রকৃতি আছে, মানুষ আছে, দেশ-কাল আছে এবং আছে প্রতীকের ব্যঞ্জনাও, আছে রূপক, আছে ছন্দের বিভিন্নমুখী ব্যবহার, অনুপ্রাসের নতুনমাত্রা, মিলবিন্যাসের নীরিক্ষা ও অন্যান্য সূক্ষ্ম কারু কাজ।

তার কবিতা ইংরেজি, ফরাসি, ডাচ, হিন্দি ও অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়ে বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হয়েছে। আমন্ত্রিত হয়ে দেশের বাইরে বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন।

ফেব্র“য়ারি, ২০১৮ পর্যন্ত একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া বিষয়ক সংস্থা ‘ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেছেন। এর আগে এফপিএবিতে উপপরিচালক (অ্যাডভোকেসি), ফোকাল পয়েন্ট ও বিভাগীয় প্রধান হিসাবে কর্মরত ছিলেন।

এ ছাড়া এফপিএবি থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘সুখী পরিবার’-এর সম্পাদক হিসাবে ১৯৮৩ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। বিসিসিপি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও যুক্ত ছিলেন। পেশাগতভাবে বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকতা, কলামলেখা, সম্পাদনা ও অ্যাডভোকেসিবিষয়ক কর্মকাণ্ডেও যুক্ত থেকেছেন।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: জুননু রাইন

যুগান্তর: প্রথম লেখা ছাপা হওয়ার অনুভূতি এবং সেই সময়ের সাহিত্যের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাই

গোলাম কিবরিয়া পিনু : গাইবান্ধা থাকাকালীন তখনই জাতীয় পত্রপত্রিকায় কবিতা ছাপা শুরু হতে থাকে, এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকার লিটল ম্যাগাজিনেও। পরে শুধু কবিতা লিখব- সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত থাকব বলেই- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অনার্সে ভর্তি হই, তখন আরও কবিতা লেখায় উদ্দীপিত হতে থাকি, কবিতার সঙ্গে তখন সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। জাতীয় পত্রপত্রিকায় তখন আরও কবিতা ছাপা হতে শুরু করে। এমনভাবেই কবিতার সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে।

যুগান্তর: আমাদের সামাজিক ইতিহাসের নিরিখে (’৭১-পরবর্তী) মননশীলতার উন্নতি বা অবনতি সম্পর্কে ২০২১ সালে এসে কী বলবেন?

গোলাম কিবরিয়া পিনু : শুধু অনুভবে নয়, বাস্তব পরিধিতে অস্থিরচিত্ততা এ সমাজে বেড়েছে বেশ, নির্লজ্জ নীতিহীনতার প্রকোপ ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে; বেদনাদীর্ণ হওয়ার পরও চিকিৎসা নেই। বিবেকতাড়িত হয়ে নীতিহীনতার বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা যেন দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে অনেক লেখকরাও দিকভ্রান্তিতে পড়ে যায়- কত রকমের ধান্দা চারদিকে, এর মধ্যে লেখকের নিজস্ব বোধ নষ্ট হতে থাকে, এগিয়ে চলার সাহস-স্পর্ধা লুপ্ত হতে থাকে।

এ সময়- টিভির বিভিন্ন চ্যানেলের ছবি ও অনুষ্ঠানের মাদকতায় টেনে নিচ্ছে মানুষকে, নেশাগ্রস্ত করে তুলছে। আবার আধুনিক হয়ে ওঠার দৌড়ে কম্পিউটার-ইন্টারনেট ও বহুবিধ যোগাযোগ ব্যবস্থায় পর্নো-মানসিকতাও সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমও পাঠক টানার কৌশলে বিভিন্ন স্টোরির নামে ভেদবুদ্ধির চালচিত্র গেলানোর জন্য মেতে উঠেছে। এসব কর্মকাণ্ডে রুচিতে এক ধরনের বাণিজ্যিক চাহিদা ও উপযোগিতা তৈরি হচ্ছে- যাতে মননশীলতার অবস্থান দূরবর্তী বদ্বীপের মতো হয়ে পড়ছে অনেকটা।

যুগান্তর: স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে বাংলাসাহিত্য কতটা বাংলাদেশি সাহিত্য হয়ে উঠতে পেরেছে? ব্রিটিশ-পাকিস্তান পরের বাংলা সাহিত্যের তুলনায় শিল্প-মানে এ সময়ের (’৭১ পরবর্তী) বাংলা সাহিত্যের অবস্থান এখন কোন পর্যায়ে?

গোলাম কিবরিয়া পিনু : ইতিহাসের কণ্ঠলগ্ন হয়ে আমাদের বিবেচনায় আষাঢ়ে গল্পে আটকে না থেকে যদি বলি, তাহলে এ দৃশ্যপট দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যে, সে সময়ে দেশ বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলার প্রথম প্রজন্মের একঝাঁক কবি, গল্প-লেখক, প্রবন্ধ-লেখকের হাতে সাহিত্যের মূলধারার পাটাতন তৈরি হতে থাকে। অন্যদিকে লেখকদের একটি ভগ্নাংশ সাহিত্যকে সংকীর্ণ বৃত্তের মধ্যে আটকে রেখে মধ্যযুগীয় ও পশ্চাৎপদ চিন্তার ঘূর্ণিজলে আবদ্ধ করতে তৎপর হয়ে ওঠে।

এর বিপরীতে শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, সানাউল হক, মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমানসহ অন্যরা, যারা আধুনিক-যুক্তিবাদি-অসাম্প্রদায়িক ও উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্য রচনার পথকে আপন পথ হিসাবে বিবেচনা করেন। ফলে এরা তাদের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তৎকালীন রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতের মধ্যেও পড়েন।

একদল অতি উৎসাহী লেখকরা চেয়েছিল ইসলামি ভাবাদর্শ নিয়ে সবাই লিখবে, এ রকম বিভিন্নমুখী চাপও ছিল। এসব চাপকে দূরে ঠেলে দিয়ে এই ভূখণ্ডের মূলধারার সাহিত্য বিকশিত হতে থাকে। পঞ্চাশ দশকের লেখকদের পথ ধরেই পরে ষাট দশকের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পাকিস্তানবিরোধী জনমত তৈরি ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নির্মাণে মূলধারার কবি-সাহিত্যিকরা ধারাবাহিক ভূমিকা রাখেন।

বাংলাদেশের ধারাবাহিক চেতনানির্ভর শিল্প-সাহিত্যের যে সজীব ও অগ্রসরমাণ ধারা, তা অনেক পর্যায়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছে, সেই ধারাকে চোরাস্রোতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক ধরনের শ্বাপদনির্ভর উন্মাদনা মাঝে মাঝে তৈরি করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মূলধারার কবি-লেখকরা এসব বিষয়ে শুধু সচেতন নয়, তারা তাদের সৃজনশীল স্পর্ধা নিয়ে শিরদাঁড়া উঁচু করে পূর্বসূরিদের মতো জোরালো ভূমিকায় বাংলাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। আজ ৭১ পরবর্তী সময়ে বাংলাসাহিত্য বিভিন্ন শাখায় দৃঢ়ভাবে এক সমৃদ্ধ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত- তা বলা যায়।

যুগান্তর: আপনার বিবেচনায় স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্য-আন্দোলন হয়েছে। আর যদি না হয়ে থাকে, এমন কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠা দরকার আছে কী?

গোলাম কিবরিয়া পিনু : আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় ধরি, প্রায় পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে, এতে উল্লেখযোগ্য ও একেবারে পরিপূর্ণ সাহিত্যনির্ভর সাহিত্য আন্দোলন গড়ে না উঠলেও- আমাদের এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের মতো মহান ইতিহাসের কণ্ঠলগ্ন চেতনা বাংলাদেশের সাহিত্য নির্মাণে বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।

মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে অনেক উল্লেখযোগ্য ‘লিটল ম্যাগাজিন’ প্রকাশিত হয়, তা সত্তর ও আশির দশকেও বেশ প্রবলভাবে ছিল, এসব ‘লিটল ম্যাগাজিন’-এর মাধ্যমে সাহিত্য-আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং তা বাংলাদেশের সাহিত্য বিকাশে ভূমিকা রাখে। এসব ‘লিটল ম্যাগাজিন’-এর দৃষ্টিভঙ্গি ও ঘোষণা বিভিন্নমুখী সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ‘লিটল ম্যাগাজিন’-এর লেখকদেরও উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে অনেকটা খণ্ড খণ্ড ভূভাগে সাহিত্য-আন্দোলন গড়ে উঠলেও তা বাংলাদেশের অখণ্ড সাহিত্যকেও বিকশিত করে।

এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক অভিঘাতও বাংলাদেশের লেখকদের ভূমিকা নির্ধারণ ও সাহিত্য রচনায় বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে থাকে। নব্বইতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দেলন, পরবর্তী সময়ে মুক্তযুদ্ধভিত্তিক গণজাগরণে লেখকদের ভূমিকা নির্ধারণ ও ভূমিকা রাখতে প্রভাবিত করে। আশির দশকে- ‘পদাবলী’, ‘কবিকণ্ঠ’, ‘বাংলাদেশ কবিতা কেন্দ্র’ ও ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’, এসব সংগঠনের মাধ্যমেও কবিদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ও আলাদা আলাদা ভূমিকার মধ্য দিয়ে সাহিত্য-আন্দোলনের চারিত্র্য লক্ষ করা যায় এবং তা এখনো প্রভাববলয় নির্ধারণে ভূমিকা রাখছে- পর্যবেক্ষণ করলেই তা অনুভব করা যায়।

যুগান্তর: বাংলাভাষার কোন গ্রন্থগুলো অন্য ভাষায় অনুবাদ হওয়া দরকার মনে করেন?

গোলাম কিবরিয়া পিনু : বাংলাভাষার দু-একটি গ্রন্থ নয়, বহু গ্রন্থই রয়েছে, যে সব অনুবাদ হওয়ার যোগ্য; কবিতা-গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ- ইত্যাদি, এগুলো বিভিন্ন সময়ের লেখা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পূর্তির সময়েও, আমরা অনুবাদের জন্য প্রতিষ্ঠানভিত্তিক কোনো রকমের সামর্থ্য গড়ে তুলতে পারিনি। ব্যক্তিগতভাবে কোনো লেখক বা অনুবাদক নিজস্ব উদ্যোগে অনুবাদ করে থাকেন কিংবা দু-একটি প্রতিষ্ঠান, যা প্রয়োজনের তুলনায় লজ্জাজনকভাবে নগণ্য। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সামর্থ্য গড়ে তুলতে হলে- এ বিষয়ে দক্ষ ও পেশাজীবী-অনুবাদক সংহত করতে হবে।

চীন সাত দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় বই অনুবাদ করে ফেলে। বাংলা সাহিত্য দেশের বাইরে পরিচিতি করানোর জন্য বাংলা একাডেমির নিজস্ব লিপিবদ্ধ দায়িত্ব রয়েছে, সে দায়িত্ব পালন কি হচ্ছে? সমকালীন বা গুরুত্বপূর্ণ বাংলাভাষায় রচিত সাহিত্য কি অনুবাদ করা হচ্ছে? বাংলা একাডেমির কি এ বিষয়ে পর্যাপ্ত দক্ষ লোকবল ও বাজেট আছে? মনে হয়- নেই! অনুবাদের জন্য একটি কার্যকর আলাদা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। অনুষ্ঠান সর্বস্ব কাজে সংস্কৃতি মন্ত্রাণালয় ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান বহু টাকা খরচ করে কিন্তু অনুবাদের জন্য কত টাকা খরচ করা হয়?

যুগান্তর: বর্তমানে বাংলাদেশের সাহিত্যে ভালো লেখকের অভাব নাকি ভালো মানের পাঠকের অভাব?

গোলাম কিবরিয়া পিনু : ভালো লেখকের অভাবও নেই, ভালো মানের পাঠকের অভাবও নেই! তবে, ভালো লেখক ও ভালো পাঠক তৈরিতে আমাদের আরও বিভিন্নমুখী সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে।

যুগান্তর: লেখক হিসাবে বহুল আলোচিত কিন্তু আপনার বিবেচনায় এদের নিয়ে এতটা আলোচনা হওয়ার কিছু নেই এমন তিনজন লেখকের নাম।

গোলাম কিবরিয়া পিনু : এমন তিনজনের নাম বলতে পারছিনা, তবে- কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান, মিডিয়ার বিভ্রান্তিমূলক ভূমিকার কারণে কেউ কেউ ‘বহুল আলোচিত লেখক’ হিসাবে ক্ষণকালের জন্য বিবেচিত হতে পারেন। তবে, তা শেষমেশ স্থায়ী হয় না। লেখক মিডিয়ার সাহায্য নিতে পারেন কিংবা মিডিয়াও লেখককে গ্রহণ করতে পারে। তবে মিডিয়া কাউকে বড় লেখক বানাতে পারে না। হয়তো সাময়িকভাবে মিডিয়া কোনো লেখককে নিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে টেনে নিয়ে নাচাতে পারে, কিন্তু শেষমেশ সেই লেখকের মর্যাদা স্থায়ী হয় না।

যুগান্তর: সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্যের কী উপকারে আসে? বাংলাদেশে সাহিত্য পুরস্কারকে সাহিত্যের জন্য কতটুকু ভালো বা মন্দ বলবেন?

গোলাম কিবরিয়া পিনু : ইদানীং সাহিত্যচর্চার চেয়ে নানা সংগঠনের অনুষ্ঠান ও পুরস্কার প্রদানের আধিক্য চোখে পড়ছে, এর অনেক কারণও আছে, আমরা আনুষ্ঠানিকতা ও প্রদর্শনবাদিতায় আগের সময়ের চেয়ে বেশি উৎসাহিত হয়ে পড়ছি- সেটাও একটা কারণ, আর অন্যদিকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধে নেওয়া-দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহিত্যকে নিজের সংকীর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসাবেও ব্যবহার করছি। সবার ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে তা বলা যাবে না, যেখানে রুচিবোধ আছে, বিবেচনাবোধ আছে এবং সাহিত্য রচনায় উৎসাহিত করার মানসিকতা আছে, তেমন অনুষ্ঠান ও পুরস্কার তা যত ছোট পরিসরে হোক, তাকে অনুমোদন করা যেতে পারে। তবে, সব প্রকৃত লেখককে অপেক্ষা করতে হয়, অপেক্ষার জন্য কঠিন নীরবতা সহ্য করা প্রকৃত লেখকের জন্য শ্রেয়। লেখকের ব্যর্থতা কী, কতটুকু, তা নিজে নিজে মূল্যায়ন করাও জরুরি, নিজের কড়া সমালোচক নিজেকেই হতে হয়।

যুগান্তর: সাহিত্যের দশক বিভাজনকে কীভাবে দেখেন?

গোলাম কিবরিয়া পিনু : সাহিত্যের দশক বিভাজন আমাদের সাহিত্য-আলোচনা ও সমালোচনায় যুক্ত হয়েছে, এতে সময়ের নিরিখে লেখকের সাহিত্যচর্চা ও অন্যান্য বিষয়ে তুলে ধরা সহজ হয়, তাতে বরং সুবিধেই হয় অনেক ক্ষেত্রে। সাহিত্যের দশক বিভাজন কীভাবে ব্যবহার হয়- তার ওপর এর বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে।

যুগান্তর: এখানে গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা কী কম আলোচিত? যদি সেটা হয়, তাহলে কী কী কারণে হচ্ছে? এমন তিনটি সমস্যার কথা উল্লেখ করুন-
গোলাম কিবরিয়া পিনু : আমাদের পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা থেকে জানি এবং বুঝি- প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ লেখক এক সময়ে আলোচনায় আসেন- হয়তো বা তা দেরিতে। এমনিতে এ দেশে সমালোচকের অভাব, তার মধ্যে সৎ সমালোচকের আরও অভাব। নৈর্ব্যক্তিকভাবে আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার বিষয়টি এখনো অনেক কম। এসব জেনে প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা সম্মান খুইয়ে আত্মমর্যাদা বন্ধক রেখে কখনো কাউকে দিয়ে তার লেখা নিয়ে আলোচনার জন্য উদগ্রীব হন না কিংবা এমন কোনো কূটকৌশলে উদ্যোগ গ্রহণ করেন না, যাতে কেউ তার বিষয়ে কৃত্রিম উদ্যোগ গ্রহণ করে।

তবে- প্রকৃত লেখকরা ভাবেন লেখাটাই তার মুখ্য হওয়া উচিত। প্রকৃত সমালোচকরা গুরুত্বপূর্ণ লেখককে আবিষ্কার করেন, চিহ্নিত করেন, টেনে তোলেন অন্ধকূপ থেকে, দেদীপ্যমান করেন নতুন আলোয়। অন্য কোনো ব্যক্তি-লোভে আর সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হিসাবে ‘তথাকথিত সমালোচনা’ ব্যবহার করেন না- কোনো সৎ সমালোচক। উদ্যোগী ও সৎ সমালোচক-সম্পাদক আমাদের মধ্যেই আছেন বলেই আমাদের অনেকের সাহিত্যচর্চা প্রবহমান আছে, এ প্রতীতি আগেও ছিল, এখনো আছে। আমরাও মনে করি- আবিষ্কারমূলক প্রণোদনায় আলোচক-সমালোচক যতই এগিয়ে আসবেন ততই রুদ্ধদ্বার খুলবে ও কৃত্রিম পরিখাও ভেঙে পড়বে।

যুগান্তর: আপনার প্রিয় দুটি বই, যা পাঠককে পড়তে বলবেন।

গোলাম কিবরিয়া পিনু : আমার অনেক প্রিয় বই, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন- ‘পৃথিবীর সব কবিতা পড়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয় কিন্তু প্রথমত নিজের দেশের সব কালের ভালো কবিতাগুলো পড়া উচিত।’ আমি একটু ঘুরিয়ে বলি- অন্য ভাষার লেখাও পড়ব- তবে, পাশাপাশি আমাদের ভাষার শুধু ভালো কবিতা নয়, ভালো গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও অন্যান্য লেখাও পড়ব।

 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন