সাক্ষাৎকারে আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

জাতীয় কল্যাণে অর্ধশতাব্দীর ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নিতে চাই

 তানজিল আমির    
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:৫৮ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী আল-আযহারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য একজন মানুষ। তার আরো পরিচয় আছে। তিনি গণভবন ও সচিবালয় মসজিদের ভূতপূর্ব ইমাম ও খতিব। 

তিনি বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুদাররেসিনের সাবেক সভাপতি, তিনি বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সভাপতি এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লেখক, গবেষক ও সম্পাদক। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠনে ভূমিকা রেখেছেন তিনি।  

ব্যতিক্রমী এ গুণী আলেমের বিস্তৃত কর্মযজ্ঞ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন- তানজিল আমির   

প্রশ্ন: ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনে আপনি সম্পৃক্ত ছিলেন? কীভাবে যুক্ত হন আন্দোলনে?

উত্তর: ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি জাতীয় ইতিহাসে মহীয়ান সন্দেহ নেই। কিন্তু ১৯৫২ সালে আমার বয়স মাত্র দশ বছর, আমি তখনো গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের ছাত্র, তাই অবদান রাখার বয়স ছিল না। 

অবশ্য ১৯৫৪ সালে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে যখন সিলেট শহরের বিখ্যাত সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হই, তখন ভাষা আন্দোলনের উদ্যোক্তা সংস্থা ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের’ সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে ‘তমদ্দুন’ নামে হস্তলিখিত ম্যাগাজিনের একাধিক সংখ্যা প্রকাশ করেছিলাম- যা হয়তো আজও কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে সংরক্ষিত আছে। 

১৯৬২ সালে ঢাকায় সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ার পর তমদ্দুন মজলিসের প্রাণপুরুষ অধ্যাপক আবুল কাসেম, অধ্যাপক শাহেদ আলী ও আব্দুল গফুর ভাই প্রমুখের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করি এবং ওই বছর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অধ্যাপক (তখন তিনি বাংলা কলেজের প্রিন্সিপাল) আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কুরআন তিলাওত করেছিলাম।

প্রশ্ন: ১৯৭১ এর আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের আসন্ন পতন নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন আপনি। কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?

উত্তর: হ্যাঁ, ১৯৬৮ সালেই আমার লিখিত এবং আমাদের আঞ্জুমানে এজহারে হক (সত্যপ্রকাশ সমিতি) থেকে প্রকাশিত ইসলামের ডাক পুস্তকে- যা ইদানীং ‘নিমজ্জমান পাকিস্তানের শেষ অধ্যায়’ নামে পুন:প্রকাশিত হয়েছে- তাতে স্পষ্ট লিখেছিলাম, যেহেতু পাকিস্তানে ঘোষিত লক্ষ্য ইসলামী ও সমতা- ভিত্তিক ন্যায্য শাসন প্রতিষ্ঠা হয়ে ওঠেনি, তাই এ রাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধভাবে টিকে থাকার ন্যায্যতা হারিয়েছে। এর পতন আসন্ন। 

আমার পুস্তকটিতে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ ও মওলানা নূর মোহাম্মদ আজমীর মত প্রখ্যাত আলেমের অভিমত সংযুক্ত ছিল। বাংলা একাডেমীর অনুবাদ বিভাগে তখন কর্মরত মওলানা মুজিবুর রহমান (হাকীম আল-মূতির পিতা) বলেছিলেন: এ হক কথার জন্যে মাওলানা আপনার কচি হাত পাষণ্ডরা মুচড়ে দিতে পারে! বলাবাহুল্য, আমি প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই কথাগুলো লিখেছিলাম।

প্রশ্ন: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন কীভাবে? এর পক্ষে আলেমদের সংগঠিত করতে পেরেছিলেন কতটা?

উত্তর: তখন আমার মতে, মওদুদীবাদই ছিল সবচেয়ে বড় ফিতনা। এদের অদূরদর্শী-মারমুখী জঙ্গী তৎপরতার কারণে এদেশে ইসলামী আন্দোলনের পথ চিরতরে রুদ্ধ হওয়ার যে আশঙ্কা আমি প্রকাশ করেছিলাম, তা তো এখন বাস্তব সত্যে পরিণত। আমি তাদের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে ১৯৭০ সালে লালমাটিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। 

পক্ষকাল যাবৎ পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবাদ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার এক সহকর্মী আনোয়ার হোসাইনকে আমার কুশলবার্তা জানার জন্যে প্রেরণ করেছিলেন। জাতীয় নেতাদের অনেকেই- যেমন ন্যাপের অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, নেজামে ইসলামের নেতা মওলানা আবদুল মজীদ খাঁ প্রমুখ অনেকেই এর প্রতিবাদ করেছিলেন।  তাদের হামলাবাজির প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী সাংবাদিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন ভাইকে তো এজন্যে প্রাণই দিতে হয়েছিল। জামাতীরা তাকে ও মাওলানা অলিউর রহমানসহ অনেককে ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ এ রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে শহীদ করেছিল। 

নাগালের মধ্যে পেলে ওরা আমাকে ও আমার অনুজ উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীকে অবশ্যই হত্যা করতো।  উবায়দুল্লাহ  ৭ই মার্চেও ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্বে কুরআন তিলাওয়াত করেছিল এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিক ছিল। ২৫ শে মার্চের কালো রাত্রিতে তিনি আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় অফিসেই ছিল এবং তারপর তাকে আমি ভারতের শিলং পর্যন্ত গিয়ে দিয়ে আসি। 

সেখানে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার পাটমন্ত্রী কালিয়াকৈরের শামসুল হক এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্যসচিব ডক্টর এম.এ. সামাদ ও আমরা একত্রে শিলং এর পাইনউড হোটেলে ছিলাম। দেশে ফিরে অনেকটা আত্মগোপনে থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশবাসীকে সক্রিয় থাকার প্রেরণা যুগিয়ে গেছি। 

স্থানীয় জামাতীরা তখনই সিলেট সদর থানায় খতরনাক মুক্তিযোদ্ধারূপে রিপোর্ট করেছিল- যা হয়তো এখনো খোঁজ করলে থানার রেকর্ডে পাওয়া যাবে। শান্তি কমিটি নেতা সরপঞ্চ কছীরুদ্দীন আমার দেশে ফেরার পর অনেক রকম জিজ্ঞাসাবাদ করে আমাকে ফাঁসাবার চেষ্টা করেছিলেন। 

আবার এক জামাত নেতা পাক-বাহিনীর কমান্ডারের কাছে আমার সম্মুখেই আমার ছোট ভাইয়ের বঙ্গবন্ধুকে লিখিত চিঠির চোরাইকৃত ফটোকপি তুলে দিয়ে আমাকে নিশ্চিত হত্যার সম্মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। আল্লাহর রহমতে প্রতুৎ মতিত্বের দ্বারা সে যাত্রা আমি রক্ষা পেয়েছিলাম।

প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার সম্পর্কের কিছু দিক যদি বলতেন।

উত্তর: বঙ্গবন্ধু পত্রপত্রিকায় আমার ও আমার ছোট ভাইয়ের বিভিন্ন সংবাদ পাঠে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ছোট ভাইটিকে সিলেট থেকে নিয়ে এসে একেবারে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস ৫১ পুরানা পল্টনে দলের দফতর সম্পাদক পরবর্তীকালে দেশের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদউল্লাহ সাহেবের পাশের কক্ষেই স্থায়ীভাবে বসিয়ে দেন। তখন তার কাজ ছিল দলের ধর্মীয় দিকটি দেখা; বঙ্গবন্ধুর ভাষায় সে ছিল তার লেফটেনেন্ট। ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে যে দিন তিন জাতীয় নেতার মাজার জিয়ারতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন আজ থেকে এদেশ বাংলাদেশ (আর পূর্ব পাকিস্তান নয়) ওই দিনের মোনাজাতও সেই পরিচালনা করেছিল। তাদের সঙ্গে আবদুর রাজ্জাক ভাইও ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু তার সিলেটী সহকর্মীদের মুখ থেকে যখন জানতে পারলেন যে, ছোট ভাইর নামে প্রকাশিত লেখালেখির উৎস আমি, তখন তারই মাধ্যমে আমাকেও তিনি সক্রিয়ভাবে মাঠে নামার আহবান জানিয়ে ছিলেন। আমি তাকে বলি যে, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আমার যা করার সবই আমি করবো, কিন্তু দলীয় প্লাটফর্ম থেকে করলে তার গ্রহণযোগ্যতা কম হবে। 

বরং আমার নেপথ্য থেকে কাজ করাই অধিকতর কার্যকর হবে। সুতরাং আমার প্রধান কাজ ছিল লেখালেখি। কেননা, অসির চাইতে মসির জোর যে বেশী, তা তো সর্বজন স্বীকৃত। সম্পূর্ণ আলেম সমাজের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় হওয়াটা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের দুই ভাইয়ের সাথে আমরা উস্তাদ মাওলানা অলিউর রহমানকেও অত্যন্ত কৌশলে শামিল করে নিতে সমর্থ হয়েছিলাম। 

তিনি জামাতীদের ‘ইত্তেহাদুল উলামা’ থেকে বের হয়ে সরাসরি আওয়ামী উলামা পার্টি গঠন করে স্বতন্ত্র ধর্ম দফতর প্রতিষ্ঠার ম্যান্ডেট নিয়ে এবং তাতে বঙ্গবন্ধুর সমর্থন ও অঙ্গীকার আদায় করে ময়দানে নেমেছিলেন- যার ফলশ্রুতিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে আমরা সমর্থ হয়েছি। বঙ্গবন্ধু আমাদের কর্মের কতটা মূল্যায়ন করতেন তার বড় প্রমাণ হলো, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমে তিনিই আমাকে প্রথম ওয়াজ মাওলানা পদে নিযুক্তি দিয়ে জুমার পূর্বে বক্তৃতার দায়িত্ব প্রদান করেন। 

তিনি আমার ছোট ভাইকে দিয়ে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্বে কুরআন তিলাওয়াত করান। তাকে মাওলানা তর্কবাগীশের সঙ্গে বায়তুল মুকাররম পরিচালনা কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করেন। ওই পর্যায়ে আমিই সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সীরাত মজলিস গঠন করে জাতির পিতাকে দিয়ে সীরাতুন্নবী জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করিয়ে বিশ্বব্যাপী তার ইসলামী ভাবমূর্তি সৃষ্টি করে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানী অপপ্রচারের উচিত জবাব দেবার ব্যবস্থা করি।  

আমার অনুরোধেই তিনি বেতার-টিভিতে পুনরায় কুরআন তিলাওয়াত ও ইসলামী অনুষ্ঠানাদি চালু করেন। তিনি আমারই অনুরোধে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন করেন, যাতে আমাকে ও আমার ভাইকে সদস্য মনোনীত করেন। মাদ্রাসা শিক্ষার জন্যে বাজেটের ঘোষণা দেন। তার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে কৌশলে এসব খিদমতের জন্যে তার সমর্থন আদায় না করলে জামায়াতের জঙ্গী কৌশলে তা কোনদিনই সম্ভব হতো না।

প্রশ্ন: বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্যচর্চায় আপনি অগ্রগণ্য একজন। আপনার সাহিত্যকর্ম নিয়ে কিছু বলবেন?

উত্তর: আলহামদুলিল্লাহ্, এ জন্যে আমি আল্লাহর শোকর আদায় করছি। ১৯৫৮ সালে সিলেটের ঐতিহাসিক মাসিক আল-ইসলাহে ‘শাহজালালের ঝর্ণা’ কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে লেখালেখির সূচনা। ১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসার ম্যাগাজিন সম্পাদনা করে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করি। তারপর মাসিক আল-ইসলাহ সাপ্তাহিক যুগভেরী (বর্তমানে দৈনিক), ঢাকার দৈনিক আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, মাসিক মদীনা প্রভৃতি পত্রিকায় শত শত প্রবন্ধ, তারপর ইসলামী বিশ্বকোষ ও সীরাত বিশ্বকোষ প্রচুর রচনা ছাড়া সেগুলোর সম্পাদনা পরিষদে বিজ্ঞ পণ্ডিতমণ্ডলীর সাথে শরীক ছিলাম এবং এখনো আউলিয়া বিশ্বকোষের সম্পাদনায় শরীক রয়েছি। লিখিত, অনূদিত, সম্পাদিত পুস্তকাদির সংখ্যা শতাধিক। 

আমার লিখিত রাসূলুল্লাহর পত্রাবলী সন্ধি চুক্তি ও ফরমানসমূহ এবং এর ইংরেজী ভাষ্য Holy Prophet’s Mission to Contemporary Rulers অনূদিত ইমাম বোখারীর আল-আদাবুল মুফরাদ এর ছয় ছয়টি সংস্করণ হয়েছে। 
মাওলানা আবুল কালাম আজাদের বিখ্যাত ‘ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম’ এর আমার অনূদিত ও লিখিত অনুবাদ ও প্রতিভাষ্য এতই জনপ্রিয় হয় যে, উভয়বঙ্গেও নন্দিত কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার কোলকাতা থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত পূর্ব-পশ্চিম নামে দেড় হাজার পৃষ্ঠার পুস্তকে আমার ওই পুস্তকের বরাত ব্যবহার করেছেন। 

১৯৭৮-২০১৬ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৮ বছর পর্যন্ত মহানবী স্মরণিকার সম্পাদক এবং ১৯৮৯-৯০ দু’বছর মাসিক মদীনার সম্পাদনা করি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ধর্ম মন্ত্রনালয়ে প্রকাশিত হজ, উমরা ও জিয়ারত ১৯৮১ থেকে এ পর্যন্ত প্রতি বছরই সরকারীভাবে ছেপে হজ যাত্রীদের হাতে তুলে দেয়া হয়ে থাকে। 

‘ইসলামী আইন ও আইন বিজ্ঞান’ শীর্ষক ই.ফা. প্রকাশিত সহস্র পৃষ্ঠার আইন পুস্তকটির ৬০ ভাগ আমার একার রচিত। 
সদ্য প্রকাশিত মাওলানা আজাদের তাফসীর ২ খন্ড (১০০০ পৃ.), রসূলুল্লাহর হজ ও উমরা (৪৭০ পৃ.) এবং প্রকাশাধীন বাঙালী লেখক কর্তৃক লিখিত সর্বপ্রথম উর্দু তাফসীর ফরিদপুরের মুফতী মুরাদুল্লাহ (১৭৫০-১৮৩০) লিখিত তাফসীরে মুরাদীয়া (৪ শতাধিক পৃষ্ঠা), ও ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম হাদিসগ্রন্থ ইমাম সাগানীর মাশারিকুল আনোয়ার (১২৭৩ পৃ.)প্রকাশনাধীন। 

এছাড়া সময়ের প্রয়োজনে লিখিত অসংখ্য প্রবন্ধ প্রাচীনতম বাংলা মাসিক নেয়ামত এবং মাসিক আল কাউসারের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে। এখনো আমি বিখ্যাত ফরাসী লেখক গোস্তাভ লি বোঁ রচিত ‘আরব সভ্যতা’ পুস্তকের অনুবাদে সক্রিয় রয়েছি। আল্লাহ্ পাক কবুল করুন।


প্রশ্ন: সামগ্রিক বিচারে অর্থেই আপনি এখন দেশের প্রবীণতম আলেম। জাতীয় জীবনে আপনার বৃহত্তর ভূমিকায় আপনাকে দেখবো না নিবৃতচারী জীবন পছন্দ করবেন?

উত্তর: ১৯৬২-৬৩ সালে মাদ্রাসা ছাত্রদের বিখ্যাত ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের আমিই ছিলাম প্রথম উদ্যোক্তা ও আহবায়ক। ওই দু’ বছর ঢাকার সর্বপ্রথম লক্ষাধিক মাদ্রাসা ছাত্রের অভাবিতপূর্ব মিছিল করিয়েছিলাম। যার ফলশ্রুতিতে কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং এ সরকারের আমলে ঢাকায় আমাদের দাবিমতে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

বাংলাদেশ আমলে জমিয়তুল মুদাররেসিনের সভাপতিরূপে হাল ধরে মাদ্রাসা শিক্ষাকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টায় অনেক বেশী শ্রম দিতে হয়েছে। এ আন্দোলনগুলোর প্রাণপুরুষরূপে মহাব্যস্ত না থাকলে সাহিত্য ক্ষেত্রে আরো বেশী অবদান রাখতে পারতাম। আল্লাহ্ তায়ালা যখন যে খেদমত  নেয়া পসন্দ করেছেন, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। 

প্রায় নিভৃতচারীরূপেই থাকলেও গণভবন মসজিদ ও বাংলাদেশ সচিবালয় মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে ব্যয়িত (১৯৭৫-২০০৫) দীর্ঘ ত্রিশ বছরের অতি ব্যস্ততায় এখন আর না থাকলেও লেখালেখিতে এখনো আল্লাহর অনুগ্রহে সক্রিয় রয়েছি। তাফসীরে জিলানী ৩য় খণ্ড সমাপ্ত হয়েছে, প্রথম ২ খন্ড ইতিপূর্বেই প্রকাশিত (প্রায় ১০০০ পৃ.) তৃতীয় খণ্ড যন্ত্রস্থ।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৬ সালে উচ্চতর ইমাম ট্রেনিং এর জন্যে সর্বপ্রথম যে টিমটি আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিল, আমি তার অন্যতম সদস্য। দু’জন ছাড়া অন্য সকল সহযাত্রী ও সহট্রেইনীরা ইন্তেকাল করেছেন। এ অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এসব দেখার দায়িত্ব যাদের তারা আগ্রহী না হলে সে সম্ভাবনা কোথায়? 

বঙ্গবন্ধুর দ্বারা সমাদৃত, মূল্যায়িত ও প্রশংসিত একজন হিসাবে এ সংকটময় মুহূর্তে অনেক কিছুই করার ছিল। আল্লাহ্ তায়ালা সেভাবে দায়িত্বপালনের সুযোগ দিলে হয়তো আরও বেশ কিছু কাজ করা যেতো। আল্লাহ্ তাআলার ইচ্ছা ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। সর্বাবস্থায় আমি আল্লাহর শোকর আদায় করি।
 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন