কাফের-ফাসেকে নয় সমস্যার সমাধান দাওয়াত ও আখলাকে: ড. আকরাম নদভি

 মূল: ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভি, অনুবাদ-মুহিম মাহফুজ 
০২ নভেম্বর ২০২২, ১০:৩৪ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ
ড. আকরাম নদভি
ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভি। ফাইল ছবি

ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভি ক্যামব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন, আসসালাম ইন্সটিটিউটের প্রিন্সিপাল এবং মার্কফিল্ড ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশনের অনারারি ভিজিটিং ফেলো। ১৯৮৯-২০১৩ পর্যন্ত তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো ছিলেন। 

তিনি মুসলিম নারী মুহাদ্দিসদের জীবনী নিয়ে ৪৩ খণ্ডে ‘আল-ওয়াফা বি আসমাইন নিসা’ নামক চরিত-কোষ রচনা করেছেন। যাতে প্রায় ১০ হাজার নারী মুহাদ্দিসদের জীবনী স্থান পেয়েছে।

বাংলাদেশ সফরে গত ২৯ অক্টোবর (শুক্রবার) তিনি বায়তুল মোকাররম ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখেন। উর্দু থেকে তা অনুলিখন ও  অনুবাদ করেছেন-মুহিম মাহফুজ

সম্মানিত আলেম-ওলামা ও প্রিয় ছাত্রবৃন্দ, আমার জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়, বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ।

১৯৯১ সনে আমি যখন অক্সফোর্ডে ছিলাম, ‘ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ’ বিষয়ক একটি প্রকল্পে কাজ করেছিলাম। হযরত শাহজালাল ইয়েমেনীসহ অন্যান্য মহান মনীষীদের কথা আমি জানি। ভারত থেকে বহু মানুষ তাদের খানকায় এসে জ্ঞান শিক্ষা করেছে। শাইখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা ঢাকার সোনারগাঁয়ে মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুহাদ্দিস এবং তিনিই সহিহ বুখারী শরীফ সর্বপ্রথম উপমহাদেশে নিয়ে আসেন। 

বঙ্গ অঞ্চলের অতীতের শাসক বা সুলতানগণ ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাধর এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক। পারস্যের মহান কবি সিরাজের সমকালে বাংলা অঞ্চলে যে শাসক ছিলেন, তিনি চিঠি মারফত সিরাজকে বাংলায় দাওয়াত দিয়েছিলেন। 

বাংলাদেশের ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবময়। এ অঞ্চলে যেমন জ্ঞান ছিল, তেমনি ধন-সম্পদের প্রাচুর্য ছিল।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? কারণ এটা ছিল সে সময়ের সম্পদসমৃদ্ধ এলাকা। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধি দিয়েছেন। বাংলাদেশের মাটিকে উর্বর বানিয়েছেন। 

মুসলিম ইতিহাসে এমন একটি সময় এসেছিল, যখন হাদিস বা সুন্নাহ বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে শৈথিল্য এসে পড়েছিল। তখন মুহাদ্দিসগণ হাদিস সংকলনের সূচনা করেছেন। ইতিহাসের আরেক সময়ে মুসলমানদের মধ্যে দর্শন চর্চা বিস্তৃত হয়ে পড়েছিলো। 

পৃথিবী বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ইবনে সিনা একটি অনবদ্য গ্রন্থ রচনা করেন 'আশশিফা'। যা মানব ইতিহাসে এক হাজার বছর পর্যন্ত অবশ্য পাঠ্য ছিল। এশিয়া-ইউরোপসহ পৃথিবীর সর্বত্র পঠিত হতো। 

ইমাম ইবনে তাইমিয়ার যুগে যুক্তিবাদী ও দার্শনিকরা যেসব আপত্তি উত্থাপন করেছেন, তিনি তার প্রতিটি প্রশ্নের সুন্দর সমাধান দিয়েছেন। একই পথ অবলম্বন করেছেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রা.)। তিনি রচনা করেছেন ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ নামক অনবদ্য গ্রন্থ। হাদিস শাস্ত্রসহ ইসলামের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রের ওপর উত্থাপিত আপত্তির দালিলিক জবাব সে গ্রন্থে তিনি দিয়েছেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভি

এখন আধুনিক যুগে নতুন ধরনের প্রশ্ন ও আপত্তি দেখা দিয়েছে। ডারউইন মনে করেন, মানব সৃষ্টির ঘটনা একটি দুর্ঘটনা মাত্র। আল্লাহ পরিকল্পনা অনুসারে মানবজাতিকে সৃষ্টি করেননি। একটি প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার মধ্যে প্রাণি সমাজ অস্তিত্ব লাভ করেছে। এই মতবাদ আমাদের স্কুলগুলোতে পড়ানো হচ্ছে। অথচ তারা কুরআন পড়তে গিয়ে এ মতবাদের বিপরীত মত আবিষ্কার করছে। ফলে তাদের মধ্যে অনেকেই কুরআন অস্বীকার করে বসছে। 

এ যুগে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন বহু বিবাহ করেছিলেন? ৬ বছর বয়সীনী হযরত আয়েশাকে (রা.) বিয়ে করেছিলেন কেন? কেউ কেউ এ প্রশ্নকে আরো জঘন্য দিকে নিয়ে যায়। 

কয়েক বছর আগে আমি আমেরিকা গিয়েছিলাম। কয়েকজন মুসলমান যুবক আমাকে জানায়, দাওয়াতের কাজের সময় খ্রিস্টান ও ইহুদিরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের প্রশ্ন করে, তোমাদের নবী বনু কোরাইজা গোত্রের সকল পুরুষকে হত্যা করেছে কেন? এটা কেমন রহমত? নাউজু বিল্লাহ। 

মানুষের মধ্যে এ ধরনের প্রশ্ন দিন দিন বেড়ে চলছে। এর ফলে মুসলমানদের অন্তর থেকে রাসুলুল্লাহর ভালোবাসা মুছে যাচ্ছে। রাসুলের ভালোবাসা অবশিষ্ট না থাকলে ইসলাম অবশিষ্ট থাকবে না। কেননা দ্বীন-ইসলামের ভিত্তি রাসুলের নিষ্কলুষ নবীসত্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত।

এখন মানুষের পকেটে ইন্টারনেট। আলেম-ওলামা ছাড়া মানুষের কাছে অন্যমাধ্যম এসে গেছে। তারা আলেমদের কাছে না গিয়ে সেসব মাধ্যম ব্যবহার করছে। আমার অনেক ছাত্র জানিয়েছে, আমাদের প্রশ্ন নিয়ে আলেমদের কাছে গেলে সন্তোষজনক জবাব পাই না। আমাদের প্রশ্ন শুনেই তারা রাগান্বিত হন। বুঝতে এবং বোঝাতে চেষ্টা করেন না। তখন আমরা ইন্টারনেট থেকে উত্তর খুঁজে নেই। এটা আমাদের জন্য ভয়ংকর ব্যাপার। অথচ আলেমদের দায়িত্ব তো কঠোরতা পরিহার করে কোমলতার সঙ্গে সংশয় নিরসন করা। চিন্তাকে প্রভাবিত করা।  এমনভাবে উপস্থাপন করা, যাতে সংশয়বাদীদের মস্তিষ্ক তা গ্রহণ করে।

ইউরোপে একটি আপত্তি তোলা হয়, ইসলাম নারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে রেখেছে। ১৯৯৪ সালে আমি ইউরোপে গেলে অনেকে প্রশ্নে এ করেন। 

আমাদের এক প্রাচ্যবিদ আমেরিকান ইংরেজ বন্ধু লিখেছেন, মুসলমানরা যদি পাঁচ জন শিক্ষিত মুসলিম নারীর নাম দেখাতে পারে, আমরা মেনে নেব, ইসলামে নারীর অধিকার আছে। আমার এ গবেষণা প্রকাশিত হবার পর তিনি আমাকে বলেন, আমি মাত্র পাঁচ জনের কথা জানতে চেয়েছিলাম। আপনি পাঁচ হাজারেরও দ্বিগুন নাম সংগ্রহ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আর কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। আলহামদুলিল্লাহ, বাস্তবতা তাই হয়েছে। অক্সফোর্ডসহ ইউরোপের সব জায়গায় সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে।

ইউরোপের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারে আমি বলেছিলাম, নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণ দর্শন শাস্ত্র। দর্শন সবসময় নারীদের অমর্যাদা করেছে। আমার কথা শুনে সবাই বিস্মিত হয়েছিল। 

আমি বলেছি, বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটল মনে করতেন, বোধ-বুদ্ধিতে নারীরা পুরুষের তুলনায় নীচু। প্রমাণ হিসেবে বলেছেন, নারীদের দাঁতের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে কম। অথচ তার নিজের স্ত্রী ছিল দুজন। তাদের দাঁত গুণে দেখলেও তিনি জানতেন, নারীদের দাঁত পুরুষের সমান। আমার বক্তব্য শুনে একজন খ্রিস্টান নারী দাঁড়িয়ে বললেন, আমি আপনার সঙ্গে একমত। খ্রিস্ট ধর্মে নারী অধিকার থাকলেও পাশ্চাত্য সমাজ নারীদের পশ্চাদপদ করে রাখছে। এর কারণ গ্রীক দর্শন।

আপনারা জানেন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে বিশ শতকের আগ পর্যন্ত নারীদের পড়ার অধিকার ছিল না। বিশ শতকের শুরুতে নারীরা অনুমোদন পায়। অথচ এর বয়স প্রায় ৮০০ বছর। ইসলাম নারীদের সম্পদের অধিকার দিয়েছে প্রায় ১৫০০ বছর আগে। অথচ ব্রিটিশ আইনে ১৯৫০ সনের আগ পর্যন্ত সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার ছিল না। 

এমনকি আইন ছিল, বিয়ের পর নারীদের নিজের ওপর নিজের অধিকার থাকবে না। ব্রিটিশ সমাজে প্রচলিত আছে, জুয়ায় হেরে কেউ তার স্ত্রীকে পর্যন্ত বাজি ধরতে পারে। নারীদের মধ্যে রুহ বা আত্মা আছে কিনা- এ নিয়ে ইউরোপে কিছুদিন আগ পর্যন্ত বিতর্ক ছিল। এ হলো আধুনিক ইউরোপের অবস্থা।

সেমিনারে দেশের শীর্ষ আলেম ও চিন্তাশীল তরুণদের সরব উপস্থিতি ছিল

আলেম সমাজকে মনে রাখতে হবে, এ যুগের ছেলে-মেয়েরা একটি নতুন পৃথিবীতে বাস করছে। পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির সংস্পর্শে তাদের মধ্যে বিচিত্র ধরনের প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিচ্ছে। অনুগ্রহ করে তাদেরকে নিজের ভাই ভাবুন। নিজের সন্তান মনে করুন। তাদের কথা শুনুন। তাদের প্রশ্নের জবাবগুলো বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করুন। বিতর্কমূলক মানসিকতা পরিহার করতে হবে। রাগ বা বিরক্তি হজম করতে হবে। মানুষকে ফাসেক-কাফের বলার দ্বারা সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। 

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে আমরা দেখি, যাকে কাফের ঘোষণা করা হয়েছে, সে আরো প্রসার লাভ করেছে। কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে আমরা কাফের ঘোষণা দিয়েছি। তাতে কি তাদের সংখ্যা কমেছে? বরং দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে। পাকিস্তানে ইসলামের চেয়ে দ্রুত গতিতে কাদিয়ানী ধর্ম প্রসার লাভ করছে। আমাদের উচিত ছিল কাদিয়ানীদের বোঝানোর চেষ্টা করা। 

ভারত ও বাংলা অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে সুফি-দরবেশদের আগমনের সময় এ অঞ্চলের মানুষ হিন্দু ছিল। তারা হিন্দুদেরকে দাওয়াত দিতেন। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতেন। ভালোবাসা বিনিময় করতেন। দাওয়াতের স্বার্থে তারা খানকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খানকায় হিন্দুদেরকে ডাকতেন। খাওয়াতেন। মেহমানদারী করতেন। এ আচরণ দেখে হিন্দুরা সহজেই মুসলমান হয়ে গিয়েছিলো। এজন্য আমাদের ভালোবাসার প্রচার করতে হবে।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন