ড. আকরাম নদভি

সংশয় নিরসন করে মানুষের হৃদয়ে ইসলামের ভালোবাসা সৃষ্টি করতে হবে

 অনলাইন ডেস্ক 
১৫ নভেম্বর ২০২২, ১০:১১ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

ড. মুহাম্মাদ আকরাম নদভি বর্তমান বিশ্বের একজন প্রখ্যাত মুসলিম স্কলার। ক্যামব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন, আসসালাম ইন্সটিটিউটের প্রিন্সিপাল এবং মার্কফিল্ড ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশনের অনারারি ভিজিটিং ফেলো। 

১৯৮৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো ছিলেন। তিনি মুসলিম নারী মুহাদ্দিসদের জীবনী নিয়ে ৪৩ খণ্ডে ‘আল-ওয়াফা বি আসমাইন নিসা’ নামক চরিত-কোষ রচনা করেছেন। যাতে প্রায় দশ হাজার নারী মুহাদ্দিসদের জীবনী স্থান পেয়েছে। এই কাজে তিনি ১৫ বছর ব্যয় করেছেন। 

বাংলাদেশ সফরের অংশ হিসেবে গত ২৯ অক্টোবর ২০২২ তিনি ঢাকা বায়তুল মোকাররম ইসলামি মিলনায়তনে উর্দু ভাষায় বক্তব্য রাখেন। আজ ছাপা হচ্ছে তার দ্বিতীয় কিস্তি। অনুলিখন ও অনুবাদ করেছেন- মুহিম মাহফুজ।

এখন আধুনিক যুগে নতুন ধরনের প্রশ্ন ও আপত্তি দেখা দিয়েছে। ডারউইন মনে করেন, মানব সৃষ্টির ঘটনা একটি দুর্ঘটনা মাত্র। আল্লাহতায়ালা পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে মানবজাতিকে সৃষ্টি করেননি। একটি প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার মধ্যে প্রাণী সমাজ অস্তিত্ব লাভ করেছে। 

এই মতবাদ আমাদের স্কুলগুলোতে পড়ানো হচ্ছে। আমাদের সন্তানেরা স্কুলে গিয়ে এই মতবাদ শিখছে এবং এটাকে সত্য হিসেবে মেনে নিচ্ছে। পরবর্তীতে তারা যখন কুরআন অধ্যয়ন করছে, স্কুলে শেখা মতবাদের বিপরীত মত কোরআনে আবিষ্কার করছে। ফলে তাদের মধ্যে অনেকেই কোরআন অস্বীকার করছে। 

অনেকে হয়তো সামাজিক লজ্জায় অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু তাদের অন্তর সংশয়ে ভরা থাকে। আলেম সমাজের দায়িত্ব, এ ধরনের নতুন মতবাদের প্রতিবাদে কিতাব রচনা করা। যুক্তি ও দলিলভিত্তিক জবাব দেওয়া। সকল সংশয় নিদর্শন করা। যেন আমাদের ধর্মে আবার ঈমানের উজ্জ্বল্য ফিরে আসে। 

এ যুগে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন বহু বিবাহ করেছিলেন? একটি দুটি নয়! একজন মানুষের জন্য এত স্ত্রীর কি প্রয়োজন হতে পারে? তার মধ্যে কি লোলুপতা ছিল? আয়েশের প্রবণতা ছিল? নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক। আল্লাহ তাআলা এই ধরনের চিন্তা ও বক্তব্য থেকে আমাদের হেফাজত করুন।

মানুষের মধ্যে এ ধরনের প্রশ্ন দিন দিন বেড়ে চলছে। এর ফলে মুসলমানদের অন্তর থেকে রাসুলুল্লাহর ভালোবাসা মুছে যাচ্ছে। যদি রাসুলের ভালোবাসা অবশিষ্ট না থাকে, তাহলে ইসলাম অবশিষ্ট থাকবে না। কেননা দ্বীন-ইসলামের ভিত্তি রাসুলের নিষ্কলুষ নবীসত্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের দায়িত্ব হল, এই প্রশ্নের সুন্দর যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান বের করা। এমনভাবে তা উপস্থাপন করা, যাতে সংশয়বাদীদের মস্তিষ্ক তা গ্রহণ করে। 

আরো প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, ৬ বছর বয়সীনী হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে কেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিয়ে করেছিলেন? কেউ কেউ এ প্রশ্নকে আরো জঘন্য দিকে নিয়ে যায়। নাউজুবিল্লাহি মিন জালিক। আলেম সমাজের কর্তব্য হল, এ প্রশ্নের সঠিক জবাব আবিষ্কার করা এবং সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। 

রাসুলুল্লাহর ওপর আরেকটি আপত্তি প্রবলভাবে উত্থাপিত হয়- কেন তিনি বনু কোরাইজা গোত্রের সকল পুরুষকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন? কয়েক বছর আগে আমি আমেরিকা গিয়েছিলাম। কয়েকজন মুসলমান দায়ী যুবক আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে। 

তারা জানায়, আমরা যখন দাওয়াতের কাজ করি, তখন খ্রিস্টান ও ইহুদীরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের বলে, তোমাদের নবী তো অত্যন্ত জালেম ছিল। বনু কোরাইজা গোত্রের সকল পুরুষকে হত্যা করেছে। শুধু মহিলারাই নিষ্কৃতি পেয়েছে। এটা কী ধরনের রহমত? অথচ তোমরা তো বলো তোমাদের নবী পুরো পৃথিবীর জন্য রহমত। তোমরা বলো ইসলাম শান্তির ধর্ম।

এই যে প্রশ্ন, এটা অমুসলিমরা আমাদের যুবক দায়ীদেরকে প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে। অথচ আমরা, ওলামায়ে কেরামগণ নিশ্চিন্ত মনে মাদরাসার ভেতরে কোরআন-হাদিস শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। আমরা অনুমানও করতে পারবো না, কী বিপুল মানুষ ইউরোপে, আমেরিকায়, পাকিস্তানে, ভারতে এমনকি বাংলাদেশে ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। 

একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, নাস্তিকতা বা ধর্মহীনতা বিষয়ক বইপত্র সব থেকে বেশি পঠিত হয় স্বয়ং সৌদি আরবে! আমেরিকায় নয়! ইউরোপে নয়! আফ্রিকায় নয়! খোদ সৌদি আরবে! কল্পনা করতে পারছেন? আমরা অনুমান করতেও ব্যর্থ হচ্ছি, মানুষ আলেমদের আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

এখন মানুষের কাছে পকেটে ইন্টারনেট। আলেম-ওলামা ছাড়া মানুষের কাছে অন্য মাধ্যম এসে গেছে। মানুষ এখন আলেমদের কাছে যাওয়ার পরিবর্তে সেসব মাধ্যম ব্যবহার করে। 

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আমার ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই জানিয়েছে, কোনো প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য তারা প্রথমেই গুগলে সার্চ করে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করে। আলেমদের কাছে যায় না। তাদের অনেকে এমনও জানিয়েছে, এসব প্রশ্ন নিয়ে আলেমদের কাছে গেলে তারা সন্তোষজনক জবাব পাই না। আমাদের প্রশ্ন শুনেই আলেমরা অসন্তুষ্ট হন। রাগান্বিত হন। বুঝতে এবং বোঝাতে চেষ্টা করেন না। তাই আমরা ইন্টারনেট থেকে উত্তর খুঁজে নেই।

এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত ভয়ংকর ব্যাপার। অথচ আলেমদের দায়িত্ব হল কঠোরতা পরিহার করে কোমলতার সঙ্গে সকল সংশয়ের নিরসন করা। চিন্তাকে প্রভাবিত করা। যখন কোন কথা বিবেক ও বোধ গ্রহণ করে, সেটা কেউ হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারে না। আমাদের এই পদ্ধতিতে কাজ করতে হবে। 

আমরা যদি অসন্তুষ্ট হই, রাগান্বিত হই, মানুষ আমাদের কথা শুনতে আসবে না। আপনারা যদি তাদেরকে মাদরাসা বা খানকা থেকে বের করে দেন, তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। যদি শক্তির মাধ্যমে কাউকে ইসলাম পালনে বাধ্য করা হয়, যতক্ষণ শক্তি থাকবে ততক্ষণ সে ইসলাম মান্য করবে। বাধ্যতা না থাকলে সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। 

কিন্তু যদি মস্তিষ্কে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করা যায়, ইসলামের সৌন্দর্যে তাকে মোহিত করা যায়, হৃদয়ে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে কখনো সে ইসলাম থেকে বিমুখ হবে না। আমাদের জন্য শুধু এটা জানিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট নয়, কোনটা হারাম আর কোনটা হালাল। কেন হারাম করা হয়েছে, কেন হালাল বলা হয়েছে কিংবা কেন ফরজ করা হয়েছে, তার কারণ জানানোও আমাদের দায়িত্ব।

একটি আপত্তি ইউরোপে ব্যাপকভাবে তোলা হয়, ইসলাম মুসলিম নারীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে রেখেছে। ১৯৯৪ সালে আমি যখন ইউরোপে যাই, অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, মুসলিম নারীরা শিক্ষায় সব থেকে পিছিয়ে কেন? এর দায় কি ইসলামের উপর বর্তায় না? ইসলাম কি নারী শিক্ষা বিরোধী? 

এ ধরনের অনেক আপত্তি ও আরোপ ইসলাম সম্পর্কে উত্থাপন করা হয়। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মুসলিম ইতিহাসের শিক্ষায় অগ্রবর্তীনী নারীদের জীবনী সংকলন করবো। কারণ শিক্ষায় অগ্রসর নারীদের জীবনী সামনে আনার মাধ্যমে এ প্রশ্নের কার্যকর জবাব দিতে হবে। 

আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া, কোন প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা ছাড়াই আমি একা এ কাজ ঘরে বসে শুরু করি। দিনভর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিউটি শেষে সন্ধ্যায় ঘরে এসে পড়াশোনা করতাম। পাশাপাশি লেখার কাজ চালিয়ে যেতাম। গবেষণার স্বার্থে আমাকে নতুন নতুন কিতাব কিনতে হতো এবং সেটা অবশ্যই নিজের টাকায়। 

অনেকে হয়তো অনুমান করতো, ইংরেজ সরকার এ প্রকল্পের জন্য আমাকে অর্থায়ন করে। কিন্তু এই প্রকল্পের জন্য কেউ আমাকে পঞ্চাশ পয়সাও দেয়নি। যত কিতাব সংগ্রহ করেছি, সম্পূর্ণ নিজের টাকায় করতে হয়েছে। 

আমি চেষ্টা করেছি, অসন্তুষ্ট হবার পরিবর্তে, রাগান্বিত বা বিরক্ত না হয়ে কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করতে, আমাদের ইতিহাস কেমন ছিল। আল্লাহর মেহেরবানীতে আমি কাজ করে যেতে থাকলাম। নারী মুহাদ্দিসদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলো। এক পর্যায়ে সেটা নয় হাজার অতিক্রম করে ফেলল। খন্ড সংখ্যা চল্লিশের ওপরে গিয়ে দাঁড়াল। এখানেই সমাপ্ত করা আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বহু ওলামায়ে কেরাম আমাকে পরামর্শ দিলেন, আপাতত গবেষণা স্থগিত করুন। নয়তো এটা কখনোই শেষ হবে না। 

আমাদের এক প্রাচ্যবিদ বন্ধু আছেন। জাতীয়তায় ইংরেজ। আমেরিকায় থাকেন। একটি বইয়ে তিনি লেখেন, মুসলমানরা বলে থাকে, তাদের ধর্মে নারী শিক্ষার ব্যাপারে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা যদি পাঁচ জন শিক্ষিত মুসলিম নারীর নাম দেখাতে পারে, আমরা তাদের দাবি মেনে নেব।

আমার এ গবেষণা প্রকাশিত হবার পর তিনি আমাকে বলেন, আমি মাত্র পাঁচ জনের কথা জানতে চেয়েছিলাম। আপনি তো পাঁচ হাজারেরও দ্বিগুন নারীদের নাম সংগ্রহ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আর কখনো কেউ প্রশ্ন তুলতে সাহস করবে না। আলহামদুলিল্লাহ। বাস্তবতা তাই হয়েছে। অক্সফোর্ডসহ ইউরোপের সব জায়গায় সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে। 

একটি ইংরেজী গবেষণাপত্রে নারী শিক্ষার ব্যাপারে একটি আপত্তি তোলা  হয়েছে, খ্রিস্ট ধর্ম, ইহুদী ধর্ম ও ইসলাম ধর্মে নারীদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এ কারণে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে আছে। এর দায় সম্পূর্ণ ধর্মের। কিন্তু আমার গবেষণা প্রকাশিত হবার পর তাদের বক্তব্য বদলে গেছে। নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হলে আমি দেখেছি। পরিবর্তিত বক্তব্যে তারা লিখেছে, সকল ধর্ম নারীদের অধিকার খর্ব করেছে। কিন্তু ইসলাম ব্যতিত। ইসলাম একমাত্র ধর্ম যাতে নারী শিক্ষার ব্যাপারে উদারতা এবং উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। 

ইউরোপের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি একবার লেকচার দিয়েছিলাম। সেখানে অনেক নারী শ্রোতা ছিল। আমি উল্টো তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেছি, নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণ মোটেই ধর্ম নয়, বরং দর্শন শাস্ত্র। দর্শন শাস্ত্র সবসময় নারীদের অমর্যাদা করেছে। এটাই নারীদের পিছিয়ে থাকার কারণ। আমার কথা শুনে সবাই বিস্মিত হয়েছিল। 

আমি বলেছি, বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটল নারীদের সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করতেন সে সম্পর্কে আপনারা অবগত আছেন। নারীদের সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, নারীরা অল্প বুদ্ধি সম্পন্না। বোধ ও বুদ্ধি বিবেচনায় তারা পুরুষের তুলনায় পশ্চাদবর্তীনী। 

এর প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছেন, নারীদের দাঁতের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে কম। অথচ চিন্তা করে দেখুন, এত বড় একজন বিজ্ঞানী! সামান্য একটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে কী বিরাট ভুল করে বসলেন। তার নিজের স্ত্রী ছিল দুজন। তিনি তাদের দাঁত গুণে দেখলেও জানতে পারতেন, নারীদের দাঁত পুরুষের চেয়ে কম হয় না। সমান হয়। 

আমি আমার গবেষণা গ্রন্থে শিয়া মুসলমান, সুন্নি মুসলমানসহ মুসলমানদের সবগুলো শাখা-উপশাখার সমস্ত নারীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছি। কিন্তু ফালসাফী ও মোতাজিলা সম্প্রদায়ের একজনের নামও পাইনি। 

আলেম-ওলামা ও ফকিহগণ নারীদের পশ্চাদপদ রাখার জন্য দায়ী নন। আমি আলেম ও ফকিহদের খানদান নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছি। তাদের নারীরা কেউ আলেম, কেউ ফকিহ, কেউ মোহাদ্দিস ছিলেন। আলেম-ওলামা তাদের নারীদের শিক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু নারীদের পশ্চাদপদ করে রেখেছে যুক্তিবিদ, বুদ্ধিবাদী ও দার্শনিক সম্প্রদায়ের পুরুষেরা। 

এমনকি হিন্দুস্তানে যখন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী হাদিসের পাঠদান শুরু করেন, সেখানেও তিনি নারীদের শিক্ষা পদ্ধতি বাতলে দেন।

মুসলমানরা সবসময় নারীদের শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহী, সচেষ্ট এবং অগ্রবর্তী। কিন্তু যারা দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত, তারা নারীদের শিক্ষার ব্যাপারে বিপরীত অবস্থান নিয়েছে। 

মুসলিম উম্মার ইতিহাসে ইমাম গাজ্জালী র. জগদ্বিখ্যাত আলেম, ফকিহ ও সুফি ছিলেন। কিন্তু তিনিও ছিলেন দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত। 

বিশেষত অ্যারিস্টটলের দর্শন তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। বাদশাহ, সুলতান ও রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য উপদেশমূলক একটি কিতাব তিনি রচনা করেন- 'আততিবরুল মাসবুক ফি নাসাইহিল মুলুক' । সেখানে অত্যন্ত উপকারী এবং সুক্ষদর্শী অসংখ্য উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু সেটাও দর্শনের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। 

সে কিতাবের শেষাংশে নারীদের বিষয়ে তিনি বাদশাদের উপদেশ দিয়ে বলেন, কখনো নারীদের সাথে কোন বিষয়ে পরামর্শ করবেন না। যদি কখনো এমন পরিস্থিতি এসে যায় যেখানে পরামর্শ করার জন্য কোন পুরুষ পাওয়া যায় না, তখন বাধ্য হয়ে পরামর্শ করলেও তাদের পরামর্শেন বিপরীত সিদ্ধান্ত নিবেন।

অথচ আমরা জানি, রাসুলুল্লাহ সা. তার ঘরের নারীদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ করেছেন। আমার সামনে আপনারা যারা বসে আছেন, আপনাদের বিষয়ে আমি যদি বলি, কেউ এদের সঙ্গে কোন বিষয়ে পরামর্শ করবেন না। যদি একান্ত বাধ্য হয়ে পরামর্শ করতেই হয়, তাহলে তারা যা বলে তার উল্টো করবেন। এতে আপনারা সন্তুষ্ট হবেন? এর চেয়ে বড় কোন অপমান হতে পারে নারীদের? এর চেয়ে বড় কোন অমূল্যায়ন হতে পারে মানুষের? 

নারীরা ভাববে, আমরা কি মানুষ নই? আমরা যা পরামর্শ দিব তার বিপরীত কাজ করতে হবে? আমরা কি মানুষের মর্যাদা পেতে পারি না?

ইমাম গাজ্জালী তার কিতাবে এ পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ এ কথা কোরআনের কোথাও নেই। হাদিসে আমরা এর বিপরীত বাস্তবতা খুঁজে পাই। 

রাসুলুল্লাহ হযরত উম্মে সালামার সাথে পরামর্শ করেছেন। এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমনকি যখন হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ উত্থাপিত হল, তখন নবীজি হযরত বারিরাহ. রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞেস করলেন, আয়েশার ব্যাপারে তোমাদের কী অভিমত? 

এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে নবিজি নারীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। যে কথা কুরআনের বিপরীত, হাদিসের পরিপন্থী সেটা ইমাম গাজ্জালী কিতাবে কিভাবে লিখলেন? নিশ্চয়ই এটা দর্শনশাস্ত্রের প্রভাব। এরিস্টটলীয় দর্শনের ফল। 

এর প্রভাবে ইমাম গাজ্জালী এমনটাও বলেছেন, পৃথিবীতে যত ফেতনা-ফাসাদ, সবই নারীদের কারণে। এটা কি সত্য হতে পারে? ইসলামের ইতিহাসে অনেক মহান মহীয়সী নারীর কথা আমরা জানি। 

উম্মাহাতুল মুমিনিনগণ ও হযরত মারিয়াম আলাইহিস সালামসহ অসংখ্য অগণিত কীর্তিমান নারীরা ইসলামের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন। তবুও নারীদের সম্পর্কে এমন বক্তব্য কেন? ফিলোসফির প্রভাব। 

মুহিম মাহফুজ

শিক্ষক: ইসলামের ইতিহাস বিভাগ, বাগমুছা ইসলামিক সেন্টার, সোনারগাঁ, নারায়নগঞ্জ

mo.mahfuz@gmail.com
 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন