পলিটিক্যালি আসিলাম

 পারভেজ রাকসান্দ কামাল, অস্ট্রেলিয়া থেকে 
২৩ মার্চ ২০২২, ১২:১৯ এএম  |  অনলাইন সংস্করণ

(১)
গত পরশু ছিল আমাদের ১০ম বিবাহবার্ষিকী। এই একটি বিষয় স্ত্রীরা কখনই ভোলেন না এবং কাউকে ভুলতেও দেননা। আর স্বামীরা যতটা পারেন কম মনে রাখতে চেষ্টা করেন। প্রেম পর্যায়ে দেখা যায় প্রেম মাঝে মাঝে নীরবে একবার আসে আবার নীরবে চলে যায়, কিন্তু বিবাহের পর বিবাহবার্ষিকীর দিনটি দামামা বাজিয়ে ঝড়ের বেগে বারবার ফিরে আসে। সেই ঝড়ের সাথে পকেট ফাঁকা করে দিয়ে চলে যায়। 

আমার স্ত্রী শিলা বিবাহের সেই কঠিন দিনটিকে দুই-তিন মাস আগে থেকেই আকারে ইংগিতে আমাকে মনে করিয়ে দিতে থাকেন। আমিও বুকে ও মুখে যথাক্রমে পাথর ও হাসি চেপে মনে পড়ার ভঙ্গী করি। মনে করানোর আবার নানা রকম তরিকা রয়েছে। এই যেমন, সেদিন সকালে নাস্তার টেবিলে আদুরে গলায় বলে বসল, “অ্যাই এইবার আমাকে কী দিবা?”
 
আমি বুঝেও না বোঝার মতো করে বলি, “কী দিব মানে? বাসায় বাজার আছে তো। শনিবারের আগে বাজার করব না। একটু চালিয়ে নাও লক্ষীটি।” 

শিলা প্রায় হোঁচট খেতে খেতে সামলিয়ে নিল। ও নিশ্চয় ধরতে পেরেছে আমার চালাকি। তারপরও মুখটা হাসি হাসি করে বলল, “আমাদের তো ১০ বছর হতে চলল। আমায় এবার কী উপহার দিবা? আমি কিন্তু ঠিক করে ফেলেছি তোমাকে একটা সারপ্রাইজ গিফট দেব।” 
এই এক সমস্যা। আমার কাছে জানতে চাচ্ছে যে, আমি কী গিফট দিব। কিন্তু নিজেরটা রয়েছে সারপ্রাইজ গিফট। এটা কী একটা পলিটিক্যালি ট্রিকস নাকি বাবা! আমি ভেবে কূলকিনারা করতে পারিনা। 
আমিও সুযোগ বুঝে বললাম, “সারপ্রাইজ গিফট হবে আমারটাও। এখন বলা যাবেনা।” সেদিনের মতো আর কথা আগালো না। অফিসে চলে আসলাম। 
অফিসে এসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভাবতে লাগলাম, কী গিফট করা যায়! আমি সবসময় সারপ্রাইজ গিফট দিতে গিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকি। আমার গিফট যদি ওর পছন্দ না হয়। আর পকেটের বিষয়টি তো শুধু মাথায় নয়, সমগ্র পকেটিই খামচে ধরে রাখতে হয়। একটু মওকা পেলেই মূহূর্তেই ফাঁকা হয়ে যাবে। অফিসে দুপুরের লাঞ্চের পর মিনিট তিরিশেক একটু চোখ বন্ধ করে ঝিমানো আমার অভ্যাস। মাঝেমধ্যে এই ঝিমানো সশব্দে হয়ে থাকে। এই কয়েকদিন সেই দিবানিদ্রা আমি দিতে পারিনি। স্বপ্নে গিফটের কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। 
যাই হোক এই কয়েকদিনের দিবানিদ্রার মায়া ত্যাগ করে বহু পরিশ্রম করে একটা আইডিয়া বের করে ফেললাম। আমার পরিচিত চারুকলার এক ছোট ভাইকে ফোন দিলাম। 
ফোন ধরে ওপাশ থেকে বলল, “সালাম বড় ভাই। কেমন আছেন? ভাই-বেরাদর গো কথা তো ভুইলাই গেছেন।”
আমি বললাম, “আরে না না, তোমাদের কথা ঠিকই মনে পড়ে। তা তুমি আছো কেমন মিয়া?”
“ঔ আছি একরকম। হাতে তেমন কাম কাইজ নাই। চইল্যা যাইতাছে।” 
“শোন তোমারে একটা ব্যপারে ফোন করছি।” 
“কইয়া ফেলান ভাই। কী ব্যপার।” 
“শোন আমার ১০ম বিবাহ বার্ষিকী। তোমার ভাবীরে একখান গিফট দিব। তুমি তোমার ভাবীর একটা পোর্ট্রেট করে দিবা। পারবা না?” 
“আরে ভাই, ভাবীর চেহারা তো মনে নাই। ক্যামনে কী আঁকুম।” 
“ও, এই কথা! এইটা তো কোন ব্যাপার না। আমি তোমার ভাবীর একটা ফটো পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওইটা দেখে দেখে আঁকবা। ঠিক আছে?”
“হ। বুঝছি। তয় কিছু খরচাপাতি লাগব।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কত?”
ছোটভাই বলল, “দিয়েন হাজার বিশেক। ওহন কিছু টাকা এডভান্স দেন।”
কথা শুনে আমার তো আত্মা খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবার উপক্রম। আমি বললাম, “আরে শোন শোন। ব্যবসা করবা অন্য লোকের সাথে। বড়ভাইদের সাথেও করবা নাকি ব্যবসা। আমি হাজার পাঁচেক টাকা দিব। তোমারে হোয়াটসঅ্যাপে ছবি দিছি। দেখো।” 
ও সব শুনে বলল, “ঠিক আছে। দেখি।” 
আমি এবার নিশ্চিন্ত। বললাম, “আচ্ছা ফোন রাখছি এখন। আমি মাস খানেক পর গিয়ে টাকা দিয়ে ছবি নিয়ে আসব।” 
মনে মনে ভাবি কম টাকার মধ্যে আনকমন গিফট। শাড়ি বা গয়না কিনতে গেলে অন্তত হাজার তিরিশ থেকে পঞ্চাশ লাগত। সেখানে পাঁচ হাজারে পার হয়ে যাব। এসব কথা কাউকে জানানো যায়না। তাই নিজের পলিটিক্যাল বুদ্ধির তারিফ নিজেই করতে থাকি।

এর মধ্যে আমি অফিসের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। পোর্ট্রেটের কথা বেমালুম ভুলে গেছি। শিলা গিফটের কথা মনে করিয়ে দিতে খেয়াল হলো। ইতিমধ্যে মাস খানেক পার হয়ে গেছে। পোর্ট্রেটের খবর জানার জন্য সেই ছোট ভাইকে একটা ফোন দিলাম। 
“সালাম বড় ভাই। আছেন কেমন?”
আমি বললাম, “এই তো ভাল আছি। তোমার ভাবীর পোর্ট্রেটের খবর কী? কবে নিতে আসব?” 
সে বলল, “আপনে তো এডভান্স পাঠাইলেন না। আর আমিও অন্য কামে বিজি হয়ে গেছিলাম। আপনার কামটা তো করবার পারিনি। ফ্রী কাম তো!”
“ফ্রী, কিসের! পাঁচ হাজার টাকা দেব বলেছি তো।”
“শোনেন বস! পাঁচ হাজারে রং, তুলি, ক্যানভাসের টাকায় উঠেনা। ভাবীরে অন্য গিফট দেন বস।” বলে ফোনটা কেটে দিল। 
এ কথা শুনে আমি ঠান্ডা এসির মধ্যেও ঘেমে উঠতে লাগলাম। এখন উপায়? কাল বাদে পরশু বিবাহবার্ষিকী। আর এখনও আমি গিফট কিনি নাই। এখন অন্য কিছু কিনতে গেলে প্রচুর টাকা খরচ হবে। আমার এখন নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে। চুলে হাত দিতেই কেমন যেন মায়া হলো। এই ১০ বছরে কয়টাই বা চুল আছে মাথায়। সেগুলোও চলে গেলে আর নিজের বলতে কীইবা থাকে! তাই ওসব চুল ছিড়া ছিড়ি বাদ দিয়ে  মাথায় হাত বুলিয়ে পরিস্থিতি সামাল কিভাবে দেওয়া যায় তাই ভাবতে বসলাম। হঠাৎ মনে হলো আমি নিজে প্রকৌশলী। ফলে ড্রয়িং করার অভ্যাস আছে ও সেই সাথে ট্রেনিংও আছে। পোর্ট্রেট আমি আঁকব। অফিসের পিয়নকে পাঠিয়ে রং, তুলি, ক্যানভাস ও পেন্সিল কিনে আনলাম। বাসায় একটা ফোন দিয়ে বললাম, “ অ্যাই শোন! অফিসে কাজের খুব চাপ। রাত হবে ফিরতে।” 
শিলা কিছু বলল না। শুনে ফোন রেখে দিল। 
যাক বাব্বাহ! শান্তিমত ছবি আঁকব। যে কারোর পোর্ট্রেট আঁকা হলো বাড়ি ঘরের ড্রয়িং করার মতোই সোজা। শুধু বুদ্ধি খরচ করে আঁকতে জানতে হয়। সুতরাং কোমড় বেঁধে, কম্পিউটারে রোমান্টিক গান চালিয়ে শুরু করলাম আঁকা। ড্রয়িঙের ক্যানভাসটি ড্রয়িং বোর্ডে সেটে দেওয়া হয়েছে। এরপর প্রকৌশলীদের টি-স্কয়ার, সেট স্কয়ার, চাঁদা, কাঁটা কম্পাস, ট্রায়াংগল স্কেল, রুলার ও পেন্সিল-রাবার সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে কাজে লেগে পড়লাম। আমি কাজের ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ গোছানো ও খরচের ক্ষেত্রে মিতব্যায়ী স্বভাবের মানুষ। শিলার যে ছবিটি আমি চারুকলার সেই ছোট ভাইকে পাঠিয়েছিলাম, সেই ছবিটি একটি ফুল স্কেপ কাগজে প্রিন্ট করে ফেললাম। তারপর স্কেলিং করে নিলাম। এইবার এই ছবিখানায় বড় স্কেলে আঁকতে শুরু করলাম। আঁকতে আঁকতে সিদ্ধান্ত নিলাম, একটু কমিক্যাল স্টাইল হলে মন্দ হয়না। অনেকটা আচারি গরুর মাংসের মতো স্বাদ হবে। টক, ঝাল, মিষ্টি। উফ ভাবতেই জিভে জল চলে আসছে। ঝাড়া তিন ঘন্টার পরিশ্রমে স্কেচ করে ফেললাম। দূরে দাড়িয়ে দেখলে, একবার শিলার মুখের মতো আবার অন্য কিছুর মতো মনে হচ্ছে। একটু কেমন যেন জ্যামিতিক অবয়ব বলে মনে হচ্ছেনা ? না না না আর এসব অলক্ষুণে কথা ভাববনা। যাক সেসব। এবার রং তুলি দিয়ে ছবিতে রং দেবার পালা। কিন্তু সেকি পিয়ন ব্যাটা এই কিসব রং কিনে এনেছে! এই রং দিয়ে আমি মুখাবয়বের কালার আনব কী করে? এতো সব ডার্ক রেঞ্জের কালার। মনে মনে বেশ রাগ হলো পিয়নের উপর। ওর মাথায় কোন বুদ্ধিই নেই। কী আর করা! অগত্যা এই সব রং দিয়ে কাজ চালাতে হবে। শুনেছি বড় বড় চিত্রশিল্পি যেমন ভ্যানগগ, ভিঞ্চি বা পিকাসো রঙের সাথে রঙ মিশিয়ে নতুন রং বানাতে পারতেন। আমিও সেই চেষ্টা করতে লাগলাম। প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা ধরে স্কেচের উপর রং লাগিয়ে ছবিটিকে একটা মানানসই রকম ব্যবস্থা করে ফেললাম। আর যেটুকু ত্রুটি বিচ্যুতি আছে তা ঐ কমিক্যাল স্টাইলের উপর পলিটিক্যালি চালিয়ে দেব। 
নিজের প্রতিভাতে আমি সত্যিই মুগ্ধ। শিলাই শুধু আমার প্রতিভার দাম দিলনা। এইবার দেখবে আমার প্রতিভা। প্রকৌশল শাস্ত্র না পড়ে চারুকলায় পড়লে বাংলাদেশে জয়নুল আবেদিন বা পটুয়া কামরুল হাসানদের মত চিত্রশিল্পি হওয়া আমার জন্য বিচিত্র কোনকালেই ছিলনা। 

(২)

অফিস থেকে বেরিয়ে পোর্ট্রেটটি একটা দোকান থেকে বাঁধিয়ে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ড্রাইভারকে গাড়ি গ্যারেজে ঢুকাতে বলে পোর্ট্রেটটি বগলদাবা করে বাসায় ঢুকলাম। শিলা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। দরজা খুলে দিল। আমার হাতে একটা বড়সড় জিনিষ দেখে শিলা জিজ্ঞেস করল, “কী এটা?” 
আমি মুচকি হেসে বললাম, “তোমার জন্য সারপ্রাইজ গিফট।” 
শিলার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলাম। ও বোধহয় ভেবেছিল যে, ছোট একটা ডায়ামন্ডের বক্স বের করব পকেট থেকে। তা না করে তার বদলে এই বিশাল ঢাউস সাইজের একটা চারকোনা জিনিস। আমি চারকোনা বাক্সটি খুলে আমার আঁকা সেই পোর্ট্রেটটি ওর সামনে মেলে ধরলাম। পোর্ট্রেটের দিকে তাকিয়ে শিলা একেবারে চুপ হয়ে গেছে। মুখ থমথমে। চোখ বারবার সরু হয়ে যাচ্ছে, আবার বড় বড় গোল গোল হয়ে যাচ্ছে। একবার ছবির দিকে তাকাচ্ছে, একবার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে আবার একবার আয়নায় নিজের দিকে তাকাচ্ছে। আমি মনে মনে পুলকিত হচ্ছি। নিশ্চয় ছবিটি ওর পছন্দ হয়েছে। এ মনে হচ্ছে তারই নমূনা। 
আমাদের পাঁচ বছরের কন্যা আমার ও শিলার কথাবার্তা শুনে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। ড্রয়িং রুমে এসে পোর্ট্রেটের দিকে ড্যাব ড্যাব করে টানা সাড়ে তিন মিনিট  তাকিয়ে থেকে বলল, “হোয়াই ইজ দ্যাট এলিফ্যান্ট অয়ারিং মামস ড্রেস?” 
কথা শেষ করেই কন্যা আর দাঁড়ালো না। ঘরে ঘুমাতে চলে গেল।
এবার আমি অতি উৎসাহে শিলার দিকে তাকিয়ে বললাম, “তোমার পোর্ট্রেট। আমি এঁকেছি।” 
শিলা বলল, “তাতো দেখতেই পাচ্ছি, আর্টিষ্ট হিসাবে তোমার নাম।” 
আমি গদগদ ভঙ্গীতে বললাম, “তোমার পছন্দ হয়নি?”
শিলা বলল, “খুব পছন্দ হয়েছে।মেয়ের কমেন্ট শোননি?” তারপর ঠান্ডা গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “এর পুরষ্কার হিসাবে, তুমি বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে। তোমার মুখ আমি দেখতে চাইনা। তোমার চোখে আমি এইরকম দেখতে। ছি: ছি:। আগামীকাল সবাইকে এই গিফট আমি কিভাবে দেখাব!” 
শিলার রুদ্রমূর্তি দেখে আমি ভয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। সেই থেকে রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঘুরছি। মনটা ভীষণ খারাপ। এই এত সুন্দর আমার প্রতিভা! এর কোন মূল্যই নেই শিলার কাছে। শিলাকে বারবার ফোন দিচ্ছি, কিন্তু ফোন ধরছেনা। ঘুরতে ঘুরতে বড়আপার বাসায় চলে আসলাম। রাত তখন তিনটা। দুলাভাই হাসতে হাসতে দরজা খুলে দিলেন। বললেন, “কী হে! গালাগালি ভাই!! দশ বছর বিবাহের গিফট শিলার পছন্দ হলোনা?” 
দুলাভাই শ্যালক না বলে আমাকে গালাগালি বলেন। শ্যালক তো বাঙালীর প্রিয় গালাগালিই। আমি কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, “মানে কী দুলাভাই? আপা কই?”
বললেন, “তোমার বউকে তোমার আপা টেলিফোনে শান্ত করছেন।” 
“তারমানে কি? শিলার যদি পোর্ট্রেটটি পছন্দ না হয়, আমাকে বলে দিলেই পারত। আমি আবার চেষ্টা করতাম। তা বলে আমার প্রতিভাকে অপমান।”
দুলাভাই বললেন, “হুম! সে তো দেখলাম তোমার শিল্পচর্চার প্রতিভা। আচ্ছা বলোতো এইরকম কুলোর মত কান, বৃত্তচাপ মার্কা চোখ, পারফেক্ট বৃত্তের মতো মুখাবয়ব তুমি আঁকলে কী করে?” 
আমি বললাম, “কাঁটা কম্পাস ও রুলার দিয়ে। কেন, কোন সমস্যা?” 
দুলাভাই বললেন, “না তেমন কোন সমস্যা নেই। সমস্যা হলো এই পোর্ট্রেটের জন্য তুমি আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছো আর তোমার আপা তোমার বউকে এই রাতদুপুরে সান্তনা দিচ্ছে।” 
আমি বললাম, “দুলাভাই, আজ রাতে আমাকে একটু থাকতে দেন।” 
দুলাভাই আঁতকে উঠে বললেন, “ঐ দাবীটি একদম করোনা। তোমাকে থাকতে দিলে তোমার আপা আমাকেও বাসা থেকে বের করে দেবে বলেছে। আমি পারবনা ভাই।” 
আমি অবাক হয়ে বললাম, “ নিজের বড়বোন আমাকে থাকতে দেবেনা? তাও কখনও হয়?” 
দুলাভাই বললেন, “হয়, হয়। খুব হয়।” 
আমি বড়আপার বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। সকাল পর্যন্ত কয়েক বন্ধুর বাসায় হানা দিলাম। সব প্রচেষ্টাই ব্যার্থ হলো। 
শেষপর্যন্ত আমি আমার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। শাশুড়ি আম্মা আমাকে খুব ভালবাসেন। আমাকে কয়েকদিন থাকতে দিবেন আশাকরি। 

শ্বশুরবাড়িতে কলিং বেল চাপতেই শাশুড়ি আম্মা দরজা খুলে দিলেন। এই সাত সকালে আমাকে দেখে বললেন, “কী ব্যাপার বাবা! তুমি এত সকালে? শিলা কোথায়?” 
আমি বললাম, “আম্মা, শিলা বাসায় আছে। আমার বড়বোনের সাথে ফোনে কথা বলছে। আর…” 
“আর কি বাবা!”
“আর আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। তাই একটু আশ্রয়ের জন্য এই বাসায় এসেছি। মানে বলতে পারেন পলিটিক্যালি আসিলাম, থাকিবার জন্য।”
শাশুড়ি বললেন, “বুঝলাম না।”
একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমার ছোট শালি আমাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। বলল, “মা, ভাইয়া রাজনৈতিক আশ্রয় বা পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম চাচ্ছে।” 
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমার এই দুরাবস্থা দেখে হাসছ?”
ও বলল, “বারে! হাসবনা? নিশ্চয় কিছু করেছেন, ভাইয়া। না হলে কেন আপা আপনাকে বের করে দিবে?” 
শাশুড়ি আম্মা আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, “আম্মা আগে কিছু খেতে দিন। একটু পানি দিন। তারপর সব বলছি।” 
সকালে ভরপেট নাস্তা খেয়ে শ্বশুর, শাশুড়ি ও শালিকে সব ঘটনা খুলে বললাম। ভাল করে বোঝালাম যে, আমি যে কতবড় মাপের একজন চিত্রশিল্পি। শুধুমাত্র ভুল করে চিত্রশিল্পি না হয়ে প্রকৌশলী হয়ে পড়েছি। প্রতিভার কতবড় অপচয়! 
সব শুনে শাশুড়ি ফোন দিলেন আমার স্ত্রী শিলাকে। বললেন, “জামাই আমাদের বাসায় আছে। তুই পোর্ট্রেটটা নিয়ে বাসায় আয়।” শিলা ওদিক থেকে কী বলল বুঝতে পারলাম না। দুপুরের দিকে শিলা, আমার বড় আপা ও দুলাভাই আমার শ্বশুরবাড়ী এসে হাজির। সাথে আমার আঁকা সেই অতুলনীয় পোর্ট্রেটটি। 
সবার সামনে পোর্ট্রেটটি উম্মোচন করা হলো। পোর্ট্রেটটি দেখে প্রথমে আমার শালী সশব্দে হেসে উঠল এরপর আমার দুলাভাই। তারপর একে একে সবাই হাসতে লাগল। শুধু আমার স্ত্রী শিলা চোখ কটমট করে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। শাশুড়ি আম্মা মুখটিপে হেসে বললেন, “ভাল হয়েছে পোর্ট্রেটটি। কিন্তু মুখের রঙ ওরকম শ্রী কৃষ্ণের গায়ের কালারের মতো কালচে নীল কেন?”
আমি বললাম, “ এতে আমার কোন দোষ নেই আম্মা। ঔ পিয়ন ব্যাটা ঠিকঠাকমত রং কিনতে পারে নাই।” 
“আর ঠোট দুটো অত মোটা মোটা কেন?”
“হঠাৎ করে রং বেশি পড়ে গিয়েছিল তাই একটু মোটা হয়ে গেছে। এরপরের বার ঠিক হবে।”
শাশুড়ি আম্মা এবার শিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে। জামাই আঁকার চেষ্টা করেছে তাই বড় কথা। তাই বলে বাসা থেকে বের করে দিবি?” 
দুলাভাই এবার শিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, “গায়ের কালার কৃষ্ণবর্ণ না হয়ে যদি একটু উজ্জল গোলাপী বর্ণ হতো, তাহলে বোধহয় শিলা অতটা অফেন্ডেড হতোনা।” 
বড় আপা বললেন, “শোন। সব কিছু ম্যানেজ করে এনেছি। তুই আমাদের সবাই কে পাঁচতারা হোটেলে ডিনার করাবি আজ আর শিলাকে একটা ডায়ামন্ডের আংটি কিনে দিবি।” 
আমি আমতা আমতা করে দুলাভায়ের দিকে তাকাতে উনি এক চোখ টিপে মাথা ঝাঁকালেন। 

সংসার জীবনে একটু বুদ্ধি করে চলতে হয়। মানে একটু পলিটিকস করে চলতে হয়। কিন্তু বেশি বুদ্ধি খাঁটাতে গেলে বুদ্ধিবিড়ম্বনাও কম পোহাতে হয় না।
তাই বলছি বেশি পলিটিক্যালি ট্রিকস না করায় ভালো।
 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন