সুখ-দু:খের গাঁথা ‘প্রবাসে মেঘ জোৎস্না’

 ডা. ফারহানা মোবিন  
২৪ মার্চ ২০২২, ০৯:২৭ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

প্রবাসে মেঘ জোৎস্না পড়ে ভালো লাগল। পুরো বইয়ে হাজার হাজার সীমানার দূর দেশে থেকেও অটুট দেশপ্রেম, প্রবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের করণীয় এবং প্রবাসের মাটিতে বাংলাদেশিদের করণীয় বিষয়গুলো বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। 

পরিবারের সবাইকে ভালো রাখবার জন্য প্রবাসের মাটিতে একজন মানুষের সীমাহীন বিসর্জন আর না পাওয়া গুলোকে লেখক ভীষণ মানবিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। 

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একজন প্রবাসী দেশে রেমিট্যান্স পাঠায়। যে টাকাগুলো দিয়ে নিজের সহযোগিতা করা যেত সেই টাকাগুলো পরিবারের জন্য, দেশের উপকারের জন্য দেশে পাঠিয়ে দেয়। 

লেখক বইটির অধিকাংশ লেখাতে প্রবাসীদের চোখের পানি লুকিয়ে, প্রবাসের মাটিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম আর অটুট মনোবল আর দেশপ্রেমকে খুব সহজ সরল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। রক্তকে পানি করে দেশের জন্য টাকা পাঠান প্রবাসীরা। কিন্তু  সেই প্রাণের বাংলাদেশে নারী নির্যাতন,খাবারে ভেজাল, রাজনীতিতে কিছু অসাধু মানুষের ঘৃণ্য অপরাধ, বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি, দূতাবাসগুলোতে সঠিক সময়ে সঠিক সহযোগিতার অভাব, প্রবাসের মাটিতে আত্মীয়স্বজনহীন ঈদের দিন। এই ধরনের বহুবিধ বিষয়গুলো লেখকের লেখনিতে উঠে এসেছে। 

বইটিতে ইতালির অপরূপ সৌন্দর্যের ভেনিস নগরী, টেনেরিফ দ্বীপ, লন্ডন ব্রিজ এর অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যগুলো লেখক খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন। মানুষের জানার কোন শেষ নেই। জমির হোসেনের এ বইয়ের মাধ্যমে জানলাম, ভেনিস এ অ্যাম্বুলেন্স এর জন্য পানি পথকে কাজে লাগাতে হয়।  

আমি জানতাম ভেনিসের চারিদিকে পানি আর পানি। রোগীর জরুরি অবস্থার জন্যও পানি পথ একমাত্র পথ বইটি পড়ে এই প্রথম আমি জানলাম। আরও জানলাম টেনেরিফ দ্বীপে রয়েছে "আস সুন্না" মসজিদ, সেখানে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের একমাত্র মসজিদ। বিষয়টা আমাকে বিস্মিত এবং মুগ্ধ করেছে। লেখক অদ্ভুত সুন্দরভাবে টেনেরিফ দ্বীপ এর সৌন্দর্য লেখনিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রবাসীদের লাশ দেশে প্রেরণের জন্য সরকার কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। 

ইতালির আকাশে পৃথিবীর সকল দেশের বিমানের পাশাপাশি বাংলাদেশের বলাকা বিমানকে আবারও দেখতে চাওয়ার ইচ্ছের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে লেখকের প্রবল দেশপ্রেম। 

ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির প্রতি ভালোবাসা আর মাতৃহারা জীবনে নিরন্তর সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রবল  ইচ্ছে ছিল লেখকের। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম বইটিতে তুলে ধরেছেন। আর তাই প্রবাসী হয়েও হৃদয়ের মন্দিরে লাল-সবুজের পতাকা।
 
লেখক হাজার মাইল দূরের দেশে থেকেও কলুষমুক্ত  একটি বাংলাদেশের জন্য হৃদয়ে ধারণ করেন স্বপনের ডালপালা। তিনি বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে দেখতে চান। ইলিশ মাছের বাড়ী চাঁদপুর লেখকের জন্মস্থান। চাঁদপুরের সাহিত্য সংস্কৃতির ছোঁয়ায়,কিছু গুণী মানুষের ভালোবাসা নিয়ে আরো বহু দূরের পথ পাড়ি দিতে চেয়েছেন লেখক। 

প্রবাসীদের লুকিয়ে রাখা দুঃখ কষ্ট, সীমাহীন বিসর্জন সংগ্রাম,দেশের রেমিট্যান্সে প্রবাসীদের অবদান,  উন্নত দেশের মাটিতে থেকেও অটুট দেশপ্রেম,নতুন দেশের মাটিতে নতুন ভাষা আর বিভিন্ন আঘাত বুক পেতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে পুরো বইয়ে তুলে ধরেছেন। 

আমি বই পড়তে খুব পছন্দ করি। সময়ের অভাবে বইটা পড়তে অনেক দেরি হয়ে গেল। জমির হোসেন এর এই বইটি অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ এ চৈতন্য প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়। আরেকটি বিষয় সবার সাথে শেয়ার করতে চাই বই পড়ার সময় আমার ভীষণ ভালোলাগার লাইনগুলো আমি সব সময় আন্ডার লাইন করি। এই বইয়ের অসংখ্য পৃষ্ঠাতে আন্ডারলাইন করেছি। 

আগামী বই মেলাতে আবারও জমির হোসেন এর লেখা নতুন আরেকটি বই এর পাঠক হবার আশায় রইলাম। প্রতি বছর ইটালিসহ অনেক দেশে যাবার জন্য অনেক তরুণরা দালালের সহযোগিতা নেয়। 

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফাঁদে আটকে যায় তারা। তারপরে ইউরোপের কোন এক সাগরে ভেসে ওঠে তাদের লাশ। আবার কখনো বা শেষ  সম্বল টুকু হারিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসে খালি হাতে। 

আমাদের এই ধরনের সম্ভাবনাময়ী তরুণদের যেন প্রবাসের কোন সাগরে লাশ হয়ে ভেসে উঠতে না হয়,  এই জন্য আপনারা যারা প্রবাসী লেখক তাদের বই পড়লে মানুষের উপকারে আসবে বিশেষ করে এই ধরনের লেখা বই আমরা আরও এরকম বই পড়তে চাই। একজন নিরপেক্ষ পাঠক হিসেবে লিখছি, জমির হোসেন এর লেখা বইটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বইটার নাম যথার্থ হয়েছে। চৈতন্য প্রকাশনার প্রকাশককে ধন্যবাদ সুন্দর একটা বই পাঠককে উপহার দেয়ার জন্য। লেখকের  জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।
 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন