অভিবাসনের সুখ-বিড়ম্বনা! (পর্ব-১০)

 মো. মাহমুদ হাসান  
২২ মে ২০২২, ১১:০৪ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

স্থায়ী অভিবাসীদের প্রথম কর্মসংস্থানটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে আবেদন করতে হবে, কোথায় যেতে হবে, কার সাহায্য নিতে হবে- এমন নানা জটিলতায় অভিবাসীদের মনে এক ভীষণ শঙ্কা আর উদ্বেগ কাজ করে। এ দেশে রেফারেন্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, রেফারেন্স ছাড়া এদেশে নিয়োগকর্তারা কাউকেই চাকরি দিতে চায় না। আমার দেশে যে বিষয়টিকে আমরা অগ্রহণযোগ্য স্বজনপ্রীতি বলি, এদেশে চাকরি পাওয়ার জন্য এই স্বজনের ভালোবাসাটাই যেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এরা বিশ্বাস করে, প্রশিক্ষণ দিয়ে একজন কে দক্ষ করে তোলা যায়, কিন্তু নৈতিক ও মানবিক গুণাবলী কোনো তাৎক্ষণিক অর্জনের বিষয় নয়। আর এসব বিষয় নিশ্চিত হতেই, রেফারেন্সটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। এমন রেফারেন্সের বদান্যতায় কানাডার মাটিতে পা রাখার আগেই আমার অন্ন, বস্ত্র আর মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত হয়ে যায়।

আলবার্টা প্রদেশের বৃহত্তম শহর কেলগেরিতে আজ আমার দ্বিতীয় দিন। জুনের তপ্ত হাওয়াকে এখানকার মানুষ হ্রদয় মন উজাড় করেই উপভোগ করছে, নারী পুরুষের বস্ত্র বিলাস দেখলে এমনটিই মনে হয়, কিন্তু বন্ধু জাহেদের দেয়া উপহারের জ্যাকেটটি গায়ে জড়িয়েও শীতল হাওয়ায় আমি যেন কাঁপছি। কেলগেরী ট্রানজিটে দু'টো ট্রান্সফার নিয়ে যথাসময়েই নতুন কর্মস্থলে পৌঁছাই। ভারতীয় বংশোদ্ভূত জন্মসূত্রে কানাডিয়ান ম্যানেজার স্যামকে প্রথম সাক্ষাতে মন্দ লাগেনি। পাঁচ দিন একনাগাড়ে চলবে প্রশিক্ষণ পর্ব। আমার বেতন ভাতা, সুযোগ সুবিধা, দায়িত্ব, কর্তব্য এক এক করে আমাকে বুঝাতে থাকলেন ম্যানেজার স্যাম। কথা আর কাজ যতই এগিয়ে যাচ্ছে, ভাষা আর সাংস্কৃতিক ভিন্নতায় আমি যেন ক্রমান্বয়েই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি।

শৈশব থেকে দেখে আসছি- ছাত্র শিক্ষককে সম্মান করে স্যার বলে, সেবা গ্রহীতা সেবা দাতার সামনে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কর্ম সম্পাদনে প্রয়োজনে সেবা দাতাকে হাজার বার স্যার বলে। আর এখানে দেখছি এর বিপরীত চিত্র! সেবাপ্রত্যাশীকে স্যার বলতে হবে। কোন অবস্থাতেই কোন সেবা গ্রহীতার সামনে চেয়ারে বসা যাবে না। মনে হলো আমার মতো এমএসএস করা একজন শিক্ষিত যুবকের প্রতি এদের যেন কোন সম্মানবোধই নেই। আট ঘণ্টার বেশিরভাগ সময় আমাকে গ্রাহক সেবার নানা কৌশল শেখানো হলো। তেরো বছরের চাকরি জীবনে যা শিখে এসেছিলাম, এর সবই যেন মূল্যহীন!! মধ্যাহ্নভোজের বিরতি ছাড়া, ম্যানেজার স্যামকে এক মিনিটের জন্যও বসতে দেখিনি। প্রতিটি গ্রাহকের প্রতি তার সৌজন্যতা আর সম্মানবোধ দেখে মনে নানা প্রশ্ন উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছিল। 

প্রশিক্ষণ চলাকালীন কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা সঙ্গত হবে কিনা, এমনটা ভেবে স্যামের শেখানো কৌশল আর প্রশিক্ষণের দিকেই মনোযোগী হই। তবে মাঝে মধ্যেই স্যাম আমাকে ভাগ্যবান বলে আখ্যায়িত করছিল। তার বর্ণনা মতে, একমাস পরেই, আমি ম্যানেজার হয়ে যাচ্ছি। বেতন ভাতা ওভারটাইমে আমার মাসিক আয় হবে পাঁচ হাজার ডলারেরও বেশি। মাহেনা আর কাজ, তার সকল বর্ণনাই আমার কাছে তখন উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতোই মনে হচ্ছে। মাসিক এক হাজার ডলারে সংসার গোছানো সম্ভব হলেও, পাঁচ হাজার ডলারের আয় রোজগার আমার কাছে যেন নস্যি হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে, আমার শিক্ষা, অভিজ্ঞতা আর দীর্ঘদিনের অর্জন এসব যেখানে মূল্যহীন, সেখানে অর্থ দিয়ে কি হবে?

একটু পরেই স্যাম আর আমি চা-বিরতিতে গেলাম। আলাপের ফাঁকে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা মানে বিদ্যার দৌড়টিও জেনে নিলাম। দু'বছর আগে টুয়েলভ শেষ করেছে, কেলগেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষ ইলেকট্রিকেল ইন্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। বেশ অমায়িক আর হাস্যমুখের স্যামের কোন কাজেই বাঁধা নেই। বাথরুম থেকে শুরু করে মেঝে পরিস্কার, সবই করছে অকপটে। কোন কাজে কোন ক্লিনিং মেটারিয়েল ব্যবহার করতে হয়, ফাঁকে ফাঁকে সেটিও আমাকে শিকিয়ে দিচ্ছে। আমার দেশে যে কাজ পরিচারিকাদের, সেটিও আমাকে করতে হবে, এটি ভেবে আমি যেন পাগল হওয়ার উপক্রম। এরা কি তাহলে আমাকে কোন অশিক্ষিত মুর্খ হিসেবে বিবেচনা করছে? তাই বা হবে কেন? আমার জীবন বৃত্তান্ত দেখে স্যাম তো আমার বেশ প্রশংসাই করেছিল।

পাতলা হাওয়াইশার্ট গায়ে দিয়ে স্যাম মনের আনন্দে সব কিছুই করে বেড়াচ্ছে, আর আমি গায়ে জ্যাকেট জড়িয়েও শীতে কাঁপছি। গরমের দিনে পূর্ণ গতিতে এয়ার কন্ডিশন চলছে, আর শীতল হাওয়ায় আমার অস্থিরতা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। এদিকে কিভাবে সেবা গ্রহীতাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হয় সেটি শিখতেই আমি গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছি। বার বার মনে হচ্ছে, কর্মস্থলে আমি যেন একজন যুতসই চাকর। তেরো বছরের চাকরি জীবনে কোনদিন কোন অধস্তনকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে হয়নি, আর সেবাগ্রহীতা! সে তো অনেক দূরের বিষয়!! 

কীভাবে সাত ঘণ্টা পেরিয়ে গেলো বুঝতে পারিনি। আর এক ঘণ্টা পর বাড়ির পথে রওয়ানা হবো, সেটি ভেবে যেন কিছুটা প্রশান্তি পাচ্ছি। এবার স্যাম আমাকে তার অফিস রুমে ঢাকলেন। সারাজীবন উর্ধতন কর্মকর্তারা যেভাবে ডেকেছেন, এবারের ডাকটি তার চেয়ে ঢের বেশি ব্যতিক্রম। কাছে এসে অতি বিনয়ের সাথে বললেন, তুমি কি দয়া করে একটু আমার রুমে আসতে পারো? আমাকে বসতে বলে তিনি বসলেন। কাজ কেমন লেগেছে জানতে চাইলেন? মনের সত্যিটা আড়াল করে বললাম, ভালো লেগেছে। এবার সেও প্রথমে আমার কাজের প্রশংসা করলো, তারপর জানালো সেবা গ্রহীতাদের সবসময় হাস্যোজ্বল মুখে সেবা দিতে হবে৷ মোদ্দা কথা আমার ফেসিয়াল ইমপ্রেসন পাল্টাতে হবে। আজব কারবার, যার জন্য কাজ করবো, তাকেই উল্টো খুশি করতে হবে, সম্মান জানাতে হবে!

স্যামের কথা শুনছি, আর মনে মনে ভাবছি তেরো বছরের চাকরি জীবনে হাজারো মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি, কত বড় বড় কর্মশালায় প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছি। এমন আজব প্রশিক্ষণ তো জীবনে দেখিনি! আমি কি অপদস্থ হচ্ছি, নাকি এটিই এদের সংস্কৃতি বুঝে উঠতে পারছি না। তবে আট ঘন্টার কর্মকালীন সময়কে যে আমি হ্রদয় দিয়ে উপভোগ করতে পারিনি, সেটি বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। দশ মিনিটের আলাপ শেষে স্যাম যখন জানতে চাইলো, আমি গাড়ি চালাই কি না? 'না' বলতেই কেলগেরি ট্রানজিটের একটি মাসিক পাস ধরিয়ে দিয়ে আজকের মতো বিদায় জানাল। 

ট্রানজিট ধরে বাড়ির পথে ফিরছি আর পরবর্তী করণীয় নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ছি। কাল একই সময়ে কাজে যেতে হবে। তার আগে সকাল দশটায় ছেলের ভ্যাক্সিনেশন এপয়েন্টমেন্ট। প্রাকৃতিক ও আকস্মিক কোনো বিপর্যয় ছাড়া এদেশে ট্রানজিট সময়ের হেরফের হয় না। তাই যথাসময়ে বাসায় পৌঁছতে কোনো অসুবিধা হয়নি। কানাডার কর্মজীবনে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা শুনতে স্ত্রী আর স্বজনদের যেন তর সইছে না। তবে আমার নীরবতা যে সুলক্ষণ নয়, সেটি বুঝতে তাদের বাকি থাকে না।

ঢাকা থেকে কেলগেরি, দীর্ঘ পথের ক্লান্তি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই, বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজে দৌড়ঝাঁপ, পরদিন থেকেই নতুন পরিবেশের কর্মস্থল। সব মিলিয়ে ক্লান্তির মাত্রাটি চরমপর্যায়ে। তাই অবসন্ন দেহে বিছানায় চলে যাই। সকালে ঘুম থেকে উঠে, স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে ভেক্সিনেশনের জন্য ঝটপট তৈরি হয়ে নেই। বাসার সামনে বাস স্টপেজ, তবুও আগে থেকে পরিকল্পনা করা সাড়ে ৮টার বাস মিস করতে হলো। ৮টা ৪৫ মিনিটে বাস ধরে ৯টা ২২ মিনিটে হেলথ সেন্টারে পৌঁছাই। বিধি বাম, সাত মিনিট দেরি হওয়াতে সিনিয়র স্টাফ নার্স জানিয়ে দিলেন রিসিডিউল করে আসতে হবে। বুঝতে পারলাম, নতুন অভিবাসী হিসেবে সময় আর পরিবেশের সঙ্গে সমন্বয় করাটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড়ে চ্যালেঞ্জ!! 
(চলবে)
 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন