দ্বিতীয় কিস্তি

ইউলিসিস

 মূল জেমস জয়েস, অনুবাদ হারুন আল রশিদ 
২৭ মে ২০২২, ১২:০০ এএম  |  অনলাইন সংস্করণ

প্রথম অধ্যায়

স্টিফেন গিয়ে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়ায়। ঝুঁকে পড়ে সে নিচের পানি আর কিংসটাউন পোতাশ্রয়ের মুখে এগিয়ে আসা ডাকবাহী জাহাজখানা দেখে।

‘আমাদের শক্তিদায়িনী মা!’ বাক মালিগান বলে। আর তার ধূসর, উৎসুক দৃষ্টি সমুদ্র থেকে ফিরিয়ে স্টিফেনের মুখের ওপর নিক্ষেপ করে।

‘আমার মাসি মনে করে তুই-ই তোর মাকে হত্যা করেছিস,’ মালিগান বলে। ‘সে জন্য মাসি আমাকে তোর সঙ্গে কিছু করতে দেবে না।’

‘কেউ না কেউ তো তাকে হত্যা করেছে,’ স্টিফেন মুখ কালো করে বলে।

‘হতভাগা কিন্চ, তোর উচিত ছিল সেই সময় হাঁটু গেড়ে বসে পড়া,’ বাক মালিগান বলে। ‘আমি তোর মতোই নিরাবেগ। তোর মুমূর্ষু মা তোকে মিনতি করছিল তার জন্য ঈশ্বরের কাছে একটু প্রার্থনা করতে, আর তুই করলি না। এ কথা যখন ভাবি তখন মনে হয় তোর মধ্যে অশুভ একটা কিছু আছে রে ...’

মালিগান কথা থামিয়ে থুতনির ভেতরের অংশে ফেনা মাখে। সহিষ্ণু স্মিতহাস্যে তার ঠোঁট বাঁকা হয়।

‘চমৎকার মূকাভিনেতা!’ সে বলে। ‘কিন্চ, তুই এক দারুণ মূকাভিনেতা!’

মালিগান সযত্নে, নীরবে দাঁড়ি কামায়।

স্টিফেন তার একটা বাহু খাঁজ-কাটা রেলিংটার ওপর রেখে হাতের তালুটা কপালে ঠেকায়, আর স্থিরদৃষ্টিতে নিজের গায়ে জড়ানো উজ্জ্বল, কালো কোটের হাতার প্রান্তে বের হয়ে থাকা কয়েকটা সুতার দিকে তাকায়। ব্যথা, যা ঠিক পুরোপুরি ভালোবাসার ব্যথা নয়, তার হৃদয় চূর্ণ করে। মৃত্যুর পর মা স্টিফেনকে স্বপ্নে এসে দেখা দিয়েছিল। নীরবে। কাফনের ভেতর মার ক্ষয়প্রাপ্ত দেহ থেকে মোম আর বিটি কাঠের গন্ধ বের হচ্ছিল। তিরস্কারপূর্ণ মুখে মা স্টিফেনের ওপর ঝুঁকে দাঁড়ায়। মায়ের শব্দহীন নিশ্বাসে ভেজা ছাইয়ের গন্ধ। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে স্টিফেন সুতা-বের-হওয়া-কোটের হাতার নিচ দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকায়, যা মালিগানের সবল কণ্ঠ ‘মহতী, মিষ্টি মা-মণি বলে’ অভিহিত করেছে। গোলাকার দিগন্ত ঘিরে সমুদ্র বিশাল এক নিষ্প্রভ সবুজ রং ধারণ করে আছে। ঠিক স্টিফেনের মায়ের পচন্ত যকৃত থেকে সশব্দ বমিতে উৎক্ষিপ্ত সবুজ, ঠান্ডা পিত্তরসের মতো।

বাক মালিগান আবারও তার ক্ষুর মোছে।

‘আহা, দুর্ভাগা কলুর বলদ!’ মালিগান দয়ালু কণ্ঠে বলে। ‘ডেডালাস, আমার তোকে একটা শার্ট আর কয়েকটা নাক-রুমাল দেওয়া উচিত। পুরোনো প্যান্ট তোর কেমন লাগে?’

‘মনে হয় ভালোই মাপসই হবে,’ স্টিফেন উত্তর করে।

বাক মালিগান ক্ষুর দিয়ে তার ঠোঁটের নিচের টোলটা আক্রমণ করে।

‘পরিহাসের বিষয় হলো,’ মালিগান পরিতৃপ্তির সঙ্গে বলে। ‘ওটা পুরোনো প্যান্টই। দাগ-টাগ লেগে কেমন হয়েছে কে জানে? বলছিলাম, আমার একটা আছে: ধূসর রঙের, তার ওপর চুলের মতো ডোরা কাটা। সেটা পরলে তোকে চমৎকার লাগবে। ঠাট্টা করছি না, কিন্চ। ভালো পোশাকে তোকে খুব মানায়।’

‘ধন্যবাদ,’ স্টিফেন বলে। ‘আমি ধূসর রং পরি না।’

‘সে ধূসর রং পরে না,’ বাক মালিগান আয়নার ভেতর তার মুখের সামনে বলে। ‘শিষ্টাচার শিষ্টাচারই। সে মাকে খুন করে, কিন্তু ধূসর প্যান্ট পরে না।’

মালিগান সিদ্ধহস্তে ক্ষুরটা খাপের ভেতর ঢুকায়। আঙুলের ডগা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মসৃণ গাল ছুঁয়ে দেখে। স্টিফেন সমুদ্র থেকে চোখ ফিরিয়ে মালিগানের সুডৌল গাল আর ক্ষিপ্র, নীল-ধোঁয়াটে চোখের দিকে তাকায়।

‘ওই মক্কেল, যার সঙ্গে আমার কাল রাতে জাহাজে দেখা হয়েছিল,’ বাক মালিগান বলে, ‘মনে করে তুই স্নায়ুতন্ত্রের উপদংশে আক্রান্ত। সে-বেটা বিশেষজ্ঞ মনঃচিকিৎসক কনলি নরমান-এর সঙ্গে ডটিভিল হাসপাতালে কাজ করেছে।’

মালিগান অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরিয়ে আয়নাটা দিয়ে সমুদ্রে বিচ্ছুরিত সূর্যালোক নিয়ে খেলে। তার কুঞ্চিত পরিষ্কার ঠোঁট আর চকচকে সাদা দাঁত হেসে ওঠে। তার সুঠাম দেহ আন্দোলিত হয়।

‘ভয়ানক কবি,’ মালিগান বলে। ‘আয়নায় তোকে দেখ।’

স্টিফেন সামনে ঝুঁকে তার দিকে মেলে ধরা আরশিতে নিজেকে দেখে। আয়নাটার এক কোনায় তারার মতো একটা ভাঙা দাগ। স্টিফেন ভাবে, মালিগান এবং অন্য সবাই আমাকে এ রকম দেখে। কী ভয়ানক! কে এই মুখটি আমার জন্য নির্ধারণ করেছিল? কে আমাকে কলুর বলদ বানিয়েছে ইঁদুর, বেজি, শিয়াল তাড়ানোর জন্য? স্টিফেন নিজের প্রতিবিম্বকে জিজ্ঞেস করে।

‘আমি মাসির বুয়ার ঘর থেকে এটা মেরে দিয়েছি,’ বাক মালিগান বলে। ‘মনে হয় না এতে তার বড় কোনো ক্ষতি হয়েছে। মাসি সব সময় সাদামাটা বুয়া রাখে। যাতে মালাকাই পুরুষরা প্রলুব্ধ না হয়। জানিস তো। মাসির নাম উরসুলা।’

মালিগান অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে আর স্টিফেনের উৎসুক চোখের সামনে থেকে আয়নটা সরিয়ে নেয়।

তোকে শেক্সপিয়ারের কালিবানের মতো লাগছে, যে আয়নায় চেহারা দেখতে না পেয়ে ক্ষেপে গিয়েছিল, মালিগান বলে। ‘আহা, যদি অস্কার ওয়াইল্ড বেঁচে থাকত তোর এই অবস্থা দেখার জন্য!’

স্টিফেন এক কদম পিছিয়ে আসে, আর আঙুল উঁচিয়ে তিক্ততার সঙ্গে বলে : ‘এটা হলো আইরিশ শিল্পের প্রতীক : চাকরানির ফাটা আয়না।’

ক্ষুর আর আয়না গাউনের পকেটে রেখে বাক মালিগান সহসা স্টিফেনকে বাহুগত করে এবং দুজনে টাওয়ারের রেলিং বরাবর হাঁটে, মালিগানের পকেটে ক্ষুর আর আয়না ক্যাক-ক্যাক শব্দ করে।

‘তোকে ঠাট্টা করা ঠিক হয়নি,’ মালিগান দয়ার্দ্র কণ্ঠে বলে। ‘ঈশ্বর জানে, আমাদের মধ্যে তুই সবচেয়ে সচেতন আর সংবেদনশীল।’

কেমন করে বাকযুদ্ধটা ঘুরিয়ে দিল সে, স্টিফেন ভাবে। মালিগান ঠিকই আমার বাক্যবাণকে ভয় পায়, যেমন আমি ভয় পাই তার তীক্ষè উপহাসকে। শীতল ইস্পাতের খোঁয়াড়ে বন্দি আমরা।

‘চাকরানির ভাঙা আয়না!’ মালিগান বলে। ‘নিচে গিয়ে ওই ইংরেজের বাচ্চার কাছে এ কথা বলে দুটি পয়সা চা। তার গায়ে টাকার দুর্গন্ধ, আর সে ভাবে তুই ভদ্রলোক নস। ওই বেটার বাপ আফ্রিকার জুলুদের কাছে কোষ্ঠকাঠিন্য সারানোর জালাপ বিক্রি করে। বা অন্য কোনো উপজাতিকে ঠকিয়ে টাকার পাহাড় গড়েছে। ঈশ্বরের দিব্যি দিয়ে বলছি, কিন্চ, আমরা দুজন একসঙ্গে কাজ করলে আয়ারল্যান্ডের জন্য কিছু একটা করতে পারতাম। অন্তত এটাকে হোমারের গ্রিস বানান যেত।’

মালিগানের বাহুর স্পর্শে স্টিফেনের মনে পড়ে তার ছোটবেলার বন্ধু ক্র্যানলির আলিঙ্গনের কথা, আর স্টিফেনের শরীরে অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে।

‘আহারে, ভাবতেই কেমন লাগে, তোকে এসব শুকরের কাছে হাত পাততে হচ্ছে,’ মালিগান বলে। ‘এখানে শুধু আমিই জানি তুই কোন ধাতুতে গড়া। তুই তো আমাকে আর একটু বিশ্বাস করতে পারিস। আমার ওপর তুই এত বিরক্ত কেন? হ্যায়নেসের জন্য? যদি সে আবার ঝামেলা করে, আমি সেইমরকে ডেকে আনব আর দুজনে মিলে হ্যায়নেসকে প্যাঁদানো দেব, ক্লাইভ কেম্পথর্প-এর চেয়েও বেশি।’

মালিগানের মুখে ক্লাইভ কেম্পথর্প-এর কথা স্টিফেন শুনেছে। হ্যায়নেসের সঙ্গে মালিগানের পরিচয় অক্সফোর্ডে, যেখানে স্টিফেন কখনো যায়নি। কিন্তু এখন স্টিফেন নিজেকে অক্সফোর্ডে কল্পনা না করে পারছে না। হোস্টেলে ক্লাইভের কক্ষে ধনির দুলালদের হইচই। স্টিফেনের চোখের ওপর কাল্পনিক ফ্যাকাশে-ইংরেজ মুখগুলো ভেসে ওঠে। হাসতে হাসতে ওরা পাঁজরের হাড্ডি খামচে ধরে। একে অন্যকে জব্দ করে। তেমন হলে আমি মরে যাব, স্টিফেন ভাবে। আর স্মরণ করে জনপ্রিয় এক আমেরিকান গানের কলি যেখানে যুদ্ধে নিহত এক বীরের কথা বলা হয়েছে। মিজ্ অব্রে, তুমি মাকে ধীরে ধীরে আমার মৃত্যু সংবাদটি দিও। অক্সফোর্ডের মাগদালেন কলেজের আদেস নামক ছোঁড়াটা। অণ্ডকোষ কেটে নেওয়ার হুমকি দিতে দিতে সে স্টিফেনকে দর্জির কাঁচি নিয়ে তাড়া করছে আর স্টিফেন টেবিলের চারদিকে ঘুরছে, স্টিফেনের শার্টের ফিতা বাতাসে উড়ছে, পায়জামার দড়ি হাঁটুর নিচে ঝুলছে। স্টিফেন বুঝে তার চেহারা হয়েছে আতঙ্কিত বাছুরের মুখের মতো যা চাটনি দিয়ে মোড়ানো। আমি চাই না কেউ আমার পায়জামা টেনে আমার পাছা উদলা করে দিক, স্টিফেন ভাবে। আমার সঙ্গে পাগলা ষাঁড়ের লড়াই, সে হবে না!

খোলা জানালা থেকে ভেসে আসা চিৎকারে গোধূলি লগনে অক্সফোর্ডের এক উঠোনে চকিত ঘাসুড়ে। যেন বধির মালি, অ্যাপ্রন পরা, দেখতে কবি ম্যাথু আরনল্ডের মতো। অন্ধকার নেমে আসা বাগানে ঘাসকাটা কল ঠেলতে ঠেলতে সে মালির চোখ পড়ে শুধু নৃত্যরত তৃণ-কণার ওপর।

হ্যায়নেসের সঙ্গে দ্বন্দ্ব নয়। এখন দরকার আমাদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন...জাতীয়তাবাদ আর ইন্দ্রিয়সুখবাদের সমন্বয়ে আমাদের নতুন পৌত্তলিকতা...আয়ারল্যান্ড হবে নতুন উন্নত সংস্কৃতির কেন্দ্র।

‘হ্যায়নেসকে থাকতে দে,’ স্টিফেন বলে। ‘ঘুমের মধ্যে পাগলামি করা ছাড়া ওর তো আর কোনো দোষ দেখি না।’

‘তোর ফোঁসফোঁসানিটা কিসের জন্য শুনি?’ বাক মালিগান অধৈর্য হয়ে বলে। ‘ঝেড়ে কাশ, বাবা। আমি কিন্তু তোর থেকে কিছু লুকোই না। এরপর আমার বিরুদ্ধে তোর আর কী বলার আছে?’

ছাদে পায়চারিরত ওরা দুজন ব্রেহেড অন্তরীপের দিকে এগিয়ে এসে থামে। অন্তরীপটা দেখে মনে হয় ঘুমন্ত কোনো তিমির চোয়াল। স্টিফেন নীরবে মালিগানের হাত থেকে তার হাতটা সরিয়ে নেয়।

email : mharunalrashid73@gmail.com

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন