এখন তরুণদের মধ্যে যুক্তিহীন অস্বীকারের প্রবণতা বেশি: মাহমুদ কামাল

 সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জুননু রাইন 
২৭ মে ২০২২, ১২:০০ এএম  |  অনলাইন সংস্করণ

আপনাদের শুরুর সময়ের সাহিত্যের পরিবেশ আর এখনকার পরিবেশে মেলালে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো ভিন্নতা চোখে পড়ে কি?

: আমাদের শুরুর সময়ে পত্রপত্রিকার সংখ্যা ছিল কম। এখন আনুপাতিক হারে পত্রিকার সংখ্যা যেমন বেশি, কবি ও কবিতার আধিক্যও সেই মাত্রারই। এখন তরুণদের মধ্যে যুক্তিহীন অস্বীকারের প্রবণতা বেশি; না পড়েই অনেকে মন্তব্য করে বসেন। সে তরুণ কবি কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ যে কেউ হোন না কেন। রাজনৈতিক বিবেচনা তো আছেই। গোষ্ঠীতন্ত্র আগেও ছিল, এখনো আছে। ভালোটা হচ্ছে এখন কাব্যচর্চার ক্ষেত্রটা বেড়েছে।

প্রযুক্তির এ পুঁজিবাদী সময়ে একজন লেখক তার লেখকসত্তাকে কতটা লালন করতে পারে?

: যিনি প্রযুক্তিকে ধারণ করতে পারেন, তিনি সেভাবে লালনও করতে পারেন। সবকিছুরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। ওষুধের ক্ষেত্রে যেমন প্রযুক্তি, এমনকি ভালোবাসার ক্ষেত্রেও। প্রযুক্তির পুঁজিবাদী চরিত্রের কারণেই অনেকের লেখকসত্তা পুঁজিতেই আটকে থাকে। তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আর গণমুখী হতে পারেন না।

লেখক হওয়ার জন্য শহরে/কেন্দ্রে চলে আসার প্রবণতাকে কীভাবে দেখেন?

: আমি যেহেতু চিরকালের বিকেন্দ্রিক, এ কারণে এর জবাব দু’রকমের হবে। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। ঢাকা না গিয়েও গ্রামে বসে অনেক কাজ করা যায়। এজন্য ঢাকা না গেলেও চলে। সবার ক্ষেত্রে নয়; অধিকাংশই মাত্র দু’দিন আগে ঢাকা গিয়ে তার জেলাকেই ‘মফস্বল’ বানিয়ে ফেলে। কেন্দ্রের চোখগুলোয় তখন ভেসে ওঠে বিভক্তির ছবি। পাশাপাশি গৌণ লেখক কেন্দ্রের সংস্পর্শে এসে সহজেই প্রচারিত লেখক হয়ে ওঠেন।

বর্তমানে সাহিত্যে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে? কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পাওয়া উচিত?

: আমি নিজে কখনো কোনো ইজম সামনে রেখে কবিতা লিখিনি। এমনকি কবিতাটি কোন ছন্দে হবে, তার কোনো প্রাক চিন্তাও কখনো করি না। লিখতে বসে সেই লেখাটি হয়ে ওঠে তারই মতো অর্থাৎ একটি চেহারায় লেখাটি দাঁড়িয়ে যায় যথাশব্দের সঙ্গে অপরিহার্য ছন্দের সংমশ্রিণে। এখন কেউ কেউ নিজস্ব যন্ত্রণাবোধকে লেখার বিষয়বস্তু করেন। এ প্রবণতা সবসময়ই ছিল; কিন্তু যন্ত্রণাবোধকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যন্ত্রণাদায়ক শব্দচয়ন পাঠবিমুখ করে তোলে সাহিত্যপ্রেমীদের। যুগে যুগে কবিতার বক্তব্য, আঙ্গিক, শব্দচয়ন সবকিছুই পালটে যায়। পালটে যাওয়া সবই কিন্তু চলে আসা সময়ে টিকে থাকে না। এখন বলা হচ্ছে, কবিতায় কোনো বিষয়েরই প্রয়োজন নেই। ছন্দহীনতার পর বিষয়হীনতা এখন অনেকের কবিতায় দৌড়াদৌড়ি করছে।

দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় ভালোবাসার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন-

: প্রযুক্তি যেমন বিশ্বকে কাছে এনেছে, পাশাপাশি মানুষকে দূরেও ঠেলে দিয়েছে। এখন একার মধ্যে পৃথিবী। ভালোবাসা তাই যান্ত্রিক হয়ে গেছে। অধিকাংশ মানুষ জনারণ্যে একাকী জীবনযাপন করতে ভালোবাসে।

আমাদের বর্তমান সাহিত্যে প্রকৃতি মানুষ জীবন কতটা নিজস্ব সৌন্দর্যে বহমান আর কতটা বিকৃতির শিকার?

: সৌন্দর্যবোধ কিন্তু নির্দিষ্ট নয়। একই বিষয় কিন্তু দেখার পার্থক্য ভিন্ন। স্বাভাবিক প্রকৃতি উধাও হয়ে যাচ্ছে। বন কেটে বসত, নদী ভরাট করে শিল্প-কারখানা কিংবা ঘরবাড়ি-এগুলো পত্রিকার পাতায় আমরা প্রতিনিয়তই দেখি। নাগরিক যন্ত্রণার মধ্যে থেকে কবিতাতেও প্রকৃতি উধাও। আমার একটি কবিতার পঙ্ক্তি ছিল এরকম- ‘ফুল, পাখি, নদী আজ কাব্যে উধাও’।

প্রযুক্তির ব্যবহার সাহিত্যের জন্য কতটা ভালো কতটা মন্দ?

: দুটি দিকই আছে। পরিমিতিবোধ বলে অভিধানে একটি শব্দ আছে। আমি কতটুকু নেব আর বর্জন করব কতটুকু-এ বোধ থেকে বলতে পারি প্রযুক্তি আমাদের অনেক সময় বাঁচিয়ে দিয়েছে। এ বেঁচে যাওয়া সময়টুকু যদি সেই প্রযুক্তির কারণেই আমরা অপব্যয় করি, তাহলে তো আর পরিমিতিটা থাকল না।

টাঙ্গাইল জেলার সাহিত্য চর্চার বর্তমান অবস্থা কেমন? কোন কোন দিকে যত্ন নিলে আরও সক্রিয় হতে পারে?

: টাঙ্গাইলকে বলা হয় কবিধাম। বর্তমান সময়ে লিখছেন অনেকেই; কিন্তু অনেকের লেখাই মানসম্পন্ন নয়। স্বর্ণযুগ ছিল ষাট ও সত্তর দশকে। বাংলা কবিতার ভুবনে এ দুই দশকের অনেক কবি জাতীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। ষাটের দশকের কবি রফিক আজাদ, আবু কায়সার, অরুণাভ সরকার, মাহবুব সাদিক, আল মুজাহিদী, সাযযাদ কাদির, বুলবুল খান মাহবুব, শাহনূর খান। সত্তরের মাহবুব হাসান, মাহবুব বারী, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, সোহরাব পাশা, আলমগীর রেজা চৌধুরী, আবু মাসুম, শাহানা মাহবুব কবিতার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নাম।

এখান থেকে সাহিত্য পত্রিকা কম বের হলেও নিয়মিত কবিতাচর্চা হচ্ছে কবিতাপাঠ অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে। টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদের আয়োজনে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে স্বরচিত কবিতাপাঠ প্রতিযোগিতা। এ পর্যন্ত ৩৪৫টি অনুষ্ঠান হয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ গ্রন্থাগারের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় দেশের বৃহত্তম বাংলাদেশ-ভারত কবিতা উৎসব। এ জেলাতেই অরণির উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে কবিতাপাঠের আয়োজন হয়েছে। কবিধাম টাঙ্গাইলে সেই হিসাবে এখন নতুন কবির আকাল চলছে। যদিও পাক্ষিক অনুষ্ঠানে গড়ে পঞ্চাশজন কবি উপস্থিত থাকেন; কিন্তু সেই অর্থে উন্নতমানের কবিতা লেখা হচ্ছে খুবই কম। এজন্য পঠন-পাঠন খুবই জরুরি। ফেসবুক আসক্তির কারণে অনেকের মধ্যে পড়াশোনার আগ্রহ নেই বললেই চলে।

বর্তমানে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক কেমন? কেমন হওয়া উচিত?

: প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র এখনো গড়ে ওঠেনি। পরিবেশ বিষয়ে আন্দোলন করতে গেলেও এখন আটক হতে হয়। রাষ্ট্র এবং জনগণ উভয়ই যার যার ক্ষেত্রে অধিকার সচেতন হলে সম্পর্কতো মধুর হওয়ারই কথা।

জন্ম : ২৩ অক্টোবর ১৯৫৭। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ এমএ। অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। সম্পাদক, সাধারণ গ্রন্থাগার টাঙ্গাইল ও সভাপতি, টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ। সম্পাদক : অরণি সাহিত্য পত্রিকা। প্রকাশিত গ্রন্থ : সম্পাদনাসহ ৪৬টি

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন