বই আলোচনা

‘বইয়ের খোঁজে’ বইয়ের খনি

 রেশমা হাওলাদার 
০৩ জুন ২০২২, ১২:০০ এএম  |  অনলাইন সংস্করণ

আমার ছোট্ট পঠন-পাঠনের গণ্ডিতে এ ধরনের বইয়ের সম্মুখীন হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। বইটি শুধু ব্যতিক্রমই নয়, বরং নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বইয়ের লেখক নিজেই এখানে একটি অসাধারণ চরিত্র। এ দেশে এই ধরনের শৌখিন মানুষ বিরল বলা তো বটেই। বইয়ের তথ্যানুযায়ী লেখকের সংগ্রহে প্রায় ৮ হাজারের কাছাকাছি বই রয়েছে। এমন ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা আমাদের দেশে আর কয়টা আছে জানি না। থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। তবে, কেন জানি মনে হচ্ছে এমন সংগ্রাহক এখন আর নেই।

একজন মানুষ কেবল সারা জীবনের সাধনায়ই এমন সংগ্রাহক হতে পারেন। এতগুলো বই সংগ্রহ, পড়া এবং কেনা সম্পর্কিত আর্থিক বিষয়াদি চিন্তা করলে এ সংগ্রাহককে আর মানুষ মনে হয় না। মনে হয় বই। মনে হয় জ্ঞান সমুদ্রে ভেসে যাওয়া সোনালি সাম্পান।

বইটি শুধু বিচ্ছিন্ন বইয়ের কথা বলছে এমন না। ‘বইয়ের খোঁজে’ পাঠক হিসাবে আমি সময়ের খোঁজ পেয়েছি, ইতিহাসের খোঁজ পেয়েছি, আরও জানতে পেরেছি জ্ঞান সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনা।

বইয়ের সূচির দিকে লক্ষ করলে এর গুরুত্ব অনেকটাই অনুধাবন করা যাবে-

‘বই ও ছাপাখানা’, ‘কে পোড়াল আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি’, ‘বই আদান-প্রদান পবর্’, “গোর্কির ‘মা’ ও একটি অপ্রত্যাশিত মৃত্যু”, ‘Taylor Wall Banks ও J. B. Bury’র সন্ধান’, ‘বই সংগ্রহে দুঃসাধ্য শ্রম ও অর্থব্যয়’, ‘বিনয় ঘোষ ও তার বই’, বি.বি. মিশ্রের ‘Adminis trative System of East India Company’ ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’, “প্রফেসর সালাহউদ্দিন আহমেদ ও ‘কথ্যইতিহাস’ প্রকল্প”, ‘অরবিন্দ ঘোষ ও জে.বি. বিউরি : দুই বিপরীত মেরুর প্রতিভা’, ‘লর্ড অ্যাকট : তার মুক্তমন ও মুক্ত সমাজচিন্তা’, ‘Man On His Past’, ‘বই কেনার জন্য বড়ভাই ৫০০ টাকা দিলেন’, ‘কার্ল মার্কস ও তার গবেষণা’, ‘আমার রাজনৈতিক চিন্তার পথ ও ফরাসি ইতিহাসবিদ ফারনান্দ ব্রাউদেল’, ‘বেকার জীবন আর বই ফেরি করার দিনগুলো’, ‘বিআইবিএম লাইব্রেরিতে নেই ‘The Bank of England : A

history!’, ‘De-lacy oleary’ ও ‘The Arabic thought and its place in history’, ‘উসমানীয় সালতানাতকালে ইস্তাম্বুল বা ইসলামবুলকেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চা’, ‘মুক্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় আব্বাসীর খেলাফতের দান’, ‘ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান’ ও আমাদের মাওলানা-মৌলভীরা’, ‘ম্যাকসিম রডিনসনের ‘Mohammed’ ও প্রাসঙ্গিক’, ‘গ্যালিলিও গ্যালিলাই সূচিত ‘Scientific Revolution’, ‘ক্লদ লেভি-স্ত্রাউস ও সাব-অলটার্ন গ্রুপের রণজিৎ গুহের বইয়ের খোঁজ’, ‘পবিত্র কোরান ও হাদিসের শিক্ষা থেকে মুসলমানদের জ্ঞানচর্চার গরিমা’, ‘এরিস্টটলের দর্শনের সঙ্গে পশ্চিমাবিশ্বকে আরবেরাই প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয়’, ‘মধ্যযুগের ধূসর ইউরোপ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ধ্যান-ধারণা’, ‘The Renaissance of the Twelfth Century’ ও আমার নতুন জীবন।’

বই সংগ্রহ, বইয়ের গুরুত্ব এবং বই সংগ্রহকালীন নানা ছোট্ট ছোট্ট ঘটনার যে শৈল্পিক বর্ণনা রয়েছে, তাতে বিভিন্ন সময়ের ইতিহাসটা আন্দাজ করা সম্ভব।

এই বইতে ‘বই আদান-প্রদান পর্ব’ শিরোনামে ছোট লেখাটির মেসেজটা অনেক বড়।

পাঠকদের সঙ্গে এই অংশটুকু শেয়ার করতে চাই-

‘১৯৮৮ সালে আমি প্রফেসর সালাহউদ্দিন আহমেদের অধীনে ‘ওরাল হিস্টরি’ নামক প্রজেক্টে যুক্ত হই। একই বছরের এপ্রিল মাসে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সাংবাদিক আবুল মোমেনের অনুপ্রেরণায় (তিনি তখন দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় কর্মরত) চট্টগ্রামের তাজ লাইব্রেরি থেকে তার একটি কবিতার বই কিনি। তার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে আমি যখন ঢাকা থেকে কোনো বই নিয়ে চট্টগ্রাম আসতাম, আবুল মোমেনের সঙ্গে বই নিয়ে আলোচনা করতাম। সময়-অসময়ে এ জ্বালাতন সত্ত্বেও আমার ওপর তাকে কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি। বরং তিনি যেন কিছুটা আশ্চর্যই হতেন এই ভেবে যে, একটি ছেলে বই সংগ্রহ করে এত আনন্দ পাচ্ছে! ১৯৯৩ সালে আমি ই. এইচ কার-এর পেংগুইন সিরিজের বই ‘The

History of Revolution’-এর দুই খণ্ড সংগ্রহ করলাম ২২০০ টাকায়। পরে টাকার প্রয়োজনে আবুল মোমেনের কাছে ওই দুই খণ্ড ৫০০ টাকায় বিক্রি করে দিই। সেই থেকে বিভিন্নজনের সঙ্গে বই আদান-প্রদানপর্ব শুরু হলো।’

এখানে লেখকের অসাধারণ জার্নির মধ্য দিয়ে একটা সময় দেখতে পাই, যখন যুবক বয়সের একজন মানুষ ৯-এর দশকে ২২০০ টাকা দিয়ে ‘The History of Revolution’-এর দুই খণ্ড সংগ্রহ করেন। ওই সময়ে তার এ আর্থিক সাহস এবং ত্যাগই বলে দেয় মোহাম্মদ সেলিম উল্লাহ’র জ্ঞান তৃষা। “গোর্কির ‘মা’ ও একটি অপ্রত্যাশিত মৃত্যু” শিরোনামের লেখার প্রথমাংশে লেখকের প্রথম কেনা বইয়ের অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিবারের সবার বইপ্রেমীর গল্পটা খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক। বইয়ের ছোট ছোট প্রত্যেকটি লেখাই পাঠককে সমৃদ্ধ হতে সহায়তা করবে। মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার বইটিকে বই না বলে বরং বইয়ের উৎস বলাই শ্রেয়। বইটি মূলত পাঠককে আরও বই পড়তে উসকে দেওয়ার কাজটিই করবে।

বইয়ের মেজাজের সঙ্গে এর গেটাপমেকাপ কেন জানি সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়নি। ভেতরের বইয়ের ছবিগুলো আরেকটু শৈল্পিকভাবে দেওয়ার দাবি রাখে।

বইয়ের খোঁজে মোহাম্মদ সেলিম উল্লাহ। প্রকাশক তৃতীয় চোখ। মূল্য ১৫০ টাকা।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন