অভিবাসনের সুখ-বিড়ম্বনা (পর্ব-১২)

 মাহমুদ হাসান  
০৪ জুলাই ২০২২, ১১:৫১ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

তৃতীয় দিনের মতো কাজের পথে রওনা হলাম। সিটি ট্রেনে পাশের সিটে অল্প বয়সী এক তরুণ। দেখে মনে হলো কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আগ বাড়িয়ে আমার সংগে পরিচিত হলেন। আলাপচারিতায় জানলাম, ভারতীয় বংশোদ্ভূত কেলগেরী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, গ্রীস্মের ছুটিতে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেন।

আমার মতোই কর্ম ক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। আজ ক'দিন আশেপাশের প্রায় সকল যাত্রীদের কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ নিয়ে আমার বড়ই কৌতুহল!! ছেলেটির কাঁধেও একটি ব্যাকপ্যাক! তাই সুযোগ বুঝে এই ব্যাগ রহস্য উদঘাটনে নেমে পড়ি। জানালেন, কেলগেরীর আবহাওয়া বড়ই বৈচিত্র্যময়। তাপমাত্রা আটটায় প্লাস হলেও নয়টায় হিমাংকের নীচে চলে যেতে পারে, তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস খুবই নির্ভরযোগ্য। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে প্রতি ঘন্টায় প্রকৃতির আচার আচরণকে বিশ্লেষণ করে পরিধানের জন্য প্রয়োজনীয় কাপড় চোপর ব্যাগে ঘুচিয়ে নেন। যখন যেটি প্রয়োজন, তখনই সেটি কাজে লাগান। পঁচিশ মিনিটের পথে তরুণ সহযাত্রীর সান্নিধ্যে বেশ কিছু নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সংযোজন মন্দ নয়। 

প্রতিটি সমাজেরই কিছু নিজস্ব রীতি নীতি আর সংস্কৃতি থাকে। পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এসব বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করেই একজন ব্যক্তির জীবন গড়ে উঠে। আমাদের সমাজে শিশুকাল থেকেই আমরা এক ধরনের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগীতায় বেড়ে উঠি। প্রত্যেক অভিভাবক প্রত্যাশা করে, তার সন্তানটি যেন স্কুলের সেরা ছাত্র হয়, শিক্ষাজীবন শেষে একজন ক্ষমতা সম্পন্ন বড় কর্তা হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বড়ত্বের এই প্রতিযোগিতার পেছনে থাকে সমীহ পাওয়ার বাসনা। ছেলে সচিব হলে বাবা-মা, আত্নীয় পরিজন সমাজের সমীহ পায়, বড় নেতা হলে প্রশাসকরা কুরনিশ করে, অর্থ বিত্তের প্রাচুর্য থাকলে ঐশ্বর্য আর ক্ষমতা সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। শিশুকাল থেকে এসব দেখতে দেখতে সমীহ পাওয়ার যে জীবনধারা তৈরি হয়েছে, এটি যেন আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো!!

কানাডীয় সংস্কৃতিতে কর্তা-কর্মীর ক্ষমতার বাহাদুরি নেই, প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন মাত্র। ইন্টারকমে চায়ের আদেশ দিলেই মুখলেস হাজির হবে, কলিংবেল চাপলেই মিলন দু,হাত জোড় করে বিনয়ের সাথে সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠবে ''জি, স্যার", কুরনিশ করার এমন উদ্ভট সংস্কৃতি এখানে নেই। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে, কর্তব্য কর্মটি যে আমার ছিল, সেটি মনে করিয়ে দেয়ার মানুষ আছে। এই মনে করিয়ে দেয়াটাকে আমার কাছে ভীষণ অপমানজনক মনে হচ্ছে। এখানে কেউ যেমন আদেশের অপেক্ষায় থাকে না, আবার আদেশ নির্দেশ আরোপ করারও সুযোগ নেই, এমন বেহাল দশায় ক্রমান্বয়েই আমি বেসামাল হয়ে উঠছি। 

আট ঘণ্টার ডিউটি, মাঝে দুটো বিরতি। মধ্যাহ্ন বিরতি ত্রিশ মিনিট, আর চা-বিরতি পনেরো মিনিট। কর্তা,কর্মীতে বৈষম্য নেই। সবার জন্য একই নিয়ম প্রযোজ্য। কাজের সময় সাত ঘন্টা পনেরো মিনিট, এর মাঝে কোন ব্যক্তিগত সময় নেই। প্রতিটি মুহূর্তের সর্বোচ্চ ব্যবহার ব্যতিত বিকল্প কোন পথ খোলা নেই। ইমারজেন্সি সিচুয়েশনে নিয়ম-নীতির শৈথিল্য থাকলেও, ঘন্টার পর ঘন্টা খোশগল্পের অবকাশ নেই। কর্মস্থলের এমন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়া বড় বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে, কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে মানসিক অস্থিরতার মাত্রা ক্রমেই অসহনশীল হয়ে উঠছে!!

আট ঘণ্টার কর্ম শেষে অবসন্ন দেহ আর বিষাদগ্রস্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরছি। ভাবছি কাল থেকে আর কাজে ফিরবো না। মনের বিপরীতে যুদ্ধ করে ঠিকে থাকা কঠিন। বেতন ভাতা যাই হোক, এ কাজ আমার নয়। তবে যাদের রেফারেন্সে দেশে থাকতেই চাকুরিটা পেয়ে গেলাম, এদের মান-মর্যাদা নিয়ে ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেলাম। নিয়োগকর্তা-ই বা বিষয়টি কে কিভাবে নেবেন!! এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে পয়তাল্লিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে মার্টিনডেলের বাসায় পৌঁছে গেলাম, তা বুঝতেই পারিনি। গিন্নি হাস্যবদনে কপাট খুলেই জানালেন, তার একটি চাকুরি হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে প্রশিক্ষণ। এক্ষেত্রেও রেফারেন্স-ই মুখ্য নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। 


ক্যালগেরিতে ভাই-ভাবির বাসায় থাকছি। পেশায় ভূতাত্ত্বিক বড় ভাইয়ের সামাজিক পরিধিটা বেশ ব্যাপক। আমলাতন্ত্রের মেধাবী সদস্য হিসেবে, কমিউনিটিতে গ্রহণযোগ্যতারও কমতি নেই। ভীতু ভীতু মনে, নানা সংশয়-সন্দেহ নিয়ে জানালাম, চাকুরিটা ছেড়ে দিতে চাই। হাসিমুখে কারণটা জানতে চাইলেন? বললাম, কোন ভাবেই নিজের সংগে মিলিয়ে নিতে পারছি না। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, বিষয়টি কে অতি স্বাভাবিক ভাবেই নিচ্ছেন। কাল সকালেই নিয়োগকর্তাকে জানিয়ে দিতে বললেন। সকাল আটটায় দুরুদুরু বুকে নিয়োগ কর্তাকে ফোন করি। চাকুরিটি ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছের কথা জানাতেই বললেন, 'সমস্যা নেই, কবে থেকে ছাড়তে চাও?' বললাম, আজ থেকেই আসতে চাই না। 


অতি বিনয়ী কণ্ঠে নিয়োগ কর্তা বললেন, তিন দিনের বেতন কালই আমার অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে যে কোনো সহযোগিতারও প্রতিশ্রুতি দিলেন। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রাগ, ক্ষোভের পরিবর্তে বাড়তি সহযোগিতার নিশ্চয়তা- এ কেমন সংস্কৃতি!! এসব ভেবেই কিছুটা সময় কেটে গেল। এদেশে নতুন অভিবাসীদের প্রাইমারি সেটেলমেন্ট সহ পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, চাকুরি ও শিক্ষা সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য নানারকম সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে। তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান, Newcomers Centre. ফোন করে এই সেন্টারের একজন এমপ্লয়মেন্ট ও সেটেলমেন্ট কাউন্সেলরের সংগে এপয়েন্টমেন্ট করে নিলাম। কাল সকাল ১০টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, তাই বায়োডাটাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আজই গুছিয়ে নিলাম। 

কানাডার বেকার ভাতার বেশ নাম ডাক। দেশে থাকতে বহুবার অনেক সবজান্তার মুখে শুনেছি, কানাডায় চাকুরি না করলে বেকার ভাতা পাওয়া যায়। হাজারো বাঙালি নাকি, কাজ না করে বেকার ভাতায় জীবন চালায়!! ভাবছি আমিও কিছুদিনের জন্য সে পথেই হাটবো। আগামী সপ্তাহ থেকে স্ত্রী চাকুরি শুরু করলে, তিন বছর বয়সী ছেলের দেখভাল করেই সময় কাটাবো। পি.আর কার্ড, সিন কার্ড, হেলথ কার্ডসহ প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্টস রাতেই গুছিয়ে নিলাম।

সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম নিউ-কামার সেন্টারে। হাস্যবদনে কাস্টোমার সার্ভিসে দায়িত্বরত মহিলা এক এক করে এই কেন্দ্র থেকে কি কি সেবা পাওয়া যায় তা অনর্গল বলে গেলেন। ঘুরে ঘুরে সবকিছুই দেখালেন। সারি সারি কম্পিউটারে বসে কেউ বায়োডাটা তৈরি করছেন, কেউ বা জব সার্চ করছেন, কেউ বা চাকুরির দরখাস্ত করছেন, কেউ কেউ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন। কিডস কর্ণারে বসে দলে দলে শিশু সন্তানেরা মনের আনন্দে খেলছে, আবার তাদের দেখভাল ও খাবার দাবারের জন্য কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। আমার শিশু সন্তানের কাছে পরিবেশটা মনে হয় বেশ যুৎসই আর আকর্ষণীয় মনে হলো। এক দৌড়ে কিডস কর্ণারে ঢুকে মনের আনন্দে খেলতে শুরু করল। 

আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্টের পাঁচ মিনিট আগেই ওয়েটিং লাউঞ্জে চলে যাই। দীর্ঘদেহী আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মিস্টার কায়েল ঠিক দশটায় লাউঞ্জে এসে আমাদের অভিবাদন জানিয়ে তার কক্ষে নিয়ে গেলেন। কুশল বিনিময়ের পর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেন। রেজিওমিটি মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। সেটেলমেন্ট সার্ভিস থেকে কিভাবে আমাদের সহযোগিতা করতে পারেন, এক এক করে এর সবই জানালেন। সদ্য অভিবাসী হওয়া যে কারও জন্য, এটি যে কত উপকারী একটি প্রোগ্রাম- সেটি বুঝতে সময় লাগেনি।

আর তিন দিন পরেই স্ত্রী কাজে যাবেন, আমাদেরও একটি নতুন অ্যাপার্টমেন্টে উঠতে হবে। এ নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা যখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেই সময়ে নিউ কামার সেন্টারের সেটেলমেন্ট এডভাইজার কায়েলের সঙ্গে সাক্ষাৎ, নিমিষেই অনেক সমস্যার সমাধান করে দিল। নতুন অ্যাপার্টমেন্টের জন্য খাট, বিছানাসহ অতি প্রয়োজনীয় কিছু আসবাবপত্রের ব্যবস্থা হলো। প্রতি মাসে সাতশো ডলারের পরিবর্তে প্রায় বিনা খরচে আমাদের কর্মকালীন ছেলেকে ডে-কেয়ার তথা আর্লি লার্নিং সেন্টারে রাখার চমৎকার তথ্য পাওয়া গেল। 

নতুন কোন অভিবাসী যখন কানাডার পথে রওনা হন, তখন নানা সংশয়, সন্দেহ নিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকেন। বিশেষ করে যাদের আত্মীয় পরিজন বা শুভাকাঙ্ক্ষী নেই, তারা বিদেশ-বিভুঁইয়ের নতুন পরিবেশে নানা রকম অসহায়ত্বে ভোগেন। যথাযথ তথ্যের অভাবে, তাদের কে বিভিন্ন রকম জটিলতা পোহাতে হয়। অথচ ফেডারেল ও প্রভিন্সিয়াল সরকার নতুন অভিবাসীদের জীবন যাত্রাকে সহজ ও অর্থবহ করতে কত রকম কল্যাণমূলক ব্যবস্থা করে রেখেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। সরকারি, বেসরকারি ও বিভিন্ন নন-প্রফিট অর্গানাইজেশনের মাধ্যমে এসব কর্মসূচী বাস্তবায়ন হচ্ছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের রিসোর্সগুলোর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে, একজন নতুন অভিবাসী নানা সংকটকে বিতাড়িত করে জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে পারে। নিউ কামার সেন্টারের সেটেলমেন্ট কাউন্সিলর কায়েলের সাথে আমাদের দীর্ঘ আলাপচারিতায় এমন অনেক বাস্তব ধর্মী তথ্য পেয়ে বেশ আশান্বিত হয়ে উঠলাম। বেকার ভাতা নিয়ে আমার আগ্রহ আর উদ্দীপনার বিষয়টিও আলোচনায় স্থান পায়। আসলেই কি 'বেকার ভাতা' বলতে কানাডায় কিছু আছে? বেকার ভাতা নয়, চাকরি বিমা আছে! কায়েলের ভাষায় আমি এ রকম সুবিধার জন্য অযোগ্য!! তাহলে যোগ্যতার মাপকাঠিই বা কী?

(চলবে)
 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন