হেনস্তার শিকার তরুণীকে নিয়ে আদালতের মন্তব্য, যা বলল দুই সংগঠন

 যুগান্তর প্রতিবেদন 
১৮ আগস্ট ২০২২, ০৮:১২ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

১৮ মে নরসিংদীর রেলস্টেশনে এক তরুণী তথাকথিত বিতর্কিত পোশাক পরার অভিযোগে জনৈক মার্জিয়া আক্তার শিলা ও তার সাঙ্গপাঙ্গ দ্বারা চরম হেনস্তার শিকার হন। পত্রিকা মারফত জানা যায়, এই সংক্রান্ত মামলায় গ্রেফতার মার্জিয়াকে ১৬ আগস্ট মঙ্গলবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ৬ মাসের জামিন দিয়েছে। নরসিংদীর রেলস্টেশনে তরুণী লাঞ্ছনার ঘটনায় মামলার জামিন আবেদন শুনানিকালে বিচারক মন্তব্য করেছেন যে, গুলশান-বনানীর মতো এলাকায়ও কোনো মেয়ে এ ধরনের পোশাক পরে রাস্তায় বের হয় না। সেখানে গ্রামের মতো একটি জায়গায় ‘পাবলিক প্লেসে’, অর্থাৎ জনপরিসরে এরকম পোশাক পরা স্বাধীনতা হতে পারে না। এই ধরনের পোশাক পরে রেলস্টেশনে যাওয়া যায় না। হাইকোর্টের এই মন্তব্যের তীব্র নিন্দা প্রতিবাদ জানিয়েছে নারী পক্ষ ও আমরা পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট নামে দুটি সংগঠন।

নারীপক্ষ হাইকোর্টের এই মন্তব্যের প্রতিবাদে জানায়, এই মন্তব্য হেনস্তাকারীদের আরও উৎসাহিত করবে। ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে, যা নারীর স্বাধীন চলাফেরাকে মারাত্মকভাবে হুমকির মধ্যে ফেলবে।

প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত বাধ্যবাধকতা ব্যাতিরেকে, একজন মানুষ কোথায় কী ধরনের পোশাক পরবে তা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত রুচি ও পছন্দের বিষয়। এরজন্য তার উপরে আক্রমণ তো দূরের কথা বরং কোনো আপত্তি, বিরূপ মন্তব্য বা অশোভন আচরণ নাগরিক মর্যাদা পরিপন্থি। বিচারপ্রার্থী মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল আদালত। সেক্ষেত্রে, হাইকোর্টের এহেন মন্তব্য অত্যন্ত অবমাননাকর এবং সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। নারীপক্ষ’র দাবি, হাইকোর্ট তার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন এবং ভবিষ্যতের আরও সতর্কতা অবলম্বন করবেন।

নরসিংদী রেলওয়েতে নারীর ওপর যৌন হয়রানির ঘটনায় আদালতের পর্যবেক্ষণ জনপরিসরে নারীর ওপর নির্যাতনকে স্বাভাবিকীকরণ করা হয়েছে বলে মনে করছে আমরাই পারি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ জোট। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন পেশার শিক্ষক, উন্নয়ন কর্মী, জেন্ডার বিশ্লেষক, মানবাধিকার কর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, আইনজীবী, লেখক, সাংবাদিক ৪৯ নারী এক বিবৃতিতে বলেন, আমরা আইনজীবীর থেকে প্রাপ্ত আদালতের এই পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহারের দাবি জানাই। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থায় এমন কোনো অসংবেদনশীল ব্যক্তির পদে থাকার দরকার নেই। যিনি এই ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ মতামত দিয়ে বাংলাদেশের নারীদের চলাচল এবং জীবনযাপনের স্বাধীনতার প্রশ্নকে হুমকিতে ফেলে।

১৮ মে নরসিংদী রেলস্টেশনে ঢাকার ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত এক নারীকে পোশাকের কারণে যৌন হেনস্তা করার ঘটনায় একজন নারীকে অভিযুক্ত হিসাবে গ্রেফতার করা হয়। মঙ্গলবার উচ্চ আদালতে বিচারপতি মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের বেঞ্চ হতে অভিযুক্ত নারীকে ছয় মাসের জামিন দেওয়া হয়। জামিনের শুনানিতে আদালত উক্ত তরুণীর পোশাককে ‘দৃষ্টিকটু’ বলে মন্তব্য করেন। পাশাপাশি জামিনের পক্ষের আইনজীবী মো. কামাল হোসেন গণমাধ্যমের কাছে জানান, ‘আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছে, গুলশান, বনানীর মতো এলাকায়ও কোনো মেয়ে এ ধরনের পোশাক পরে রাস্তায় বের হয় না। সেখানে গ্রামের মতো একটি জায়গায় পাবলিক প্লেসে এ রকম পোশাক পরা স্বাধীনতা হতে পারে না। যেমন খুশি তেমন পোশাকের নামে আমাদের সোসাইটির কালচারকে ধ্বংস করতে পারে না। ওই মেয়ে যে ধরনের পোশাক পরিহিত ছিল সেটা আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থার সঙ্গে বেমানান। যে কারণেই প্রতিবাদের শিকার হয়েছিল।’ এছাড়াও আইনজীবী কামাল হোসেন এই ঘটনাটিকে ‘৬০ বছর বয়সি একজন নারীর পক্ষে কীভাবে ২২ বছর বয়সি মেয়েকে যৌন হেনস্তা করা হয়েছে এটা বোধগম্য নয়’ বলে এই মামলাকে অযাচিত বলতে চেয়েছেন। আমরাই পারি জোট মনে করছে, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ জনপরিসরে নারীর ওপর নির্যাতনকে স্বাভাবিকীকরণ করা হয়েছে এবং এর ফলে পাবলিস প্লেসে নারীর চলাচল আরও হুমকির সম্মুখীন হবে। 

আমরাই পারি মনে করছে, আইনজীবীর বক্তব্য অনুযায়ী আদালতের এই পর্যবেক্ষণ পুরুষ আধিপত্যমূলক এবং পশ্চাদপদ মানসিকতা প্রসূত যা বাংলাদেশের মত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন নাগরিক হিসাবে নারীর সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে। আমাদের সংবিধানের ২৮ ধারাতে বলা রয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা এর ১৪নং পৃষ্ঠায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়ন না করা এবং বৈষম্যমূলক সামাজিক প্রথার বৃদ্ধি হ্রাস করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নরসিংদীতে উক্ত ঘটনায় কেবল ‘নারী’ বলেই উক্ত তরুণীকে হেনস্তা করা হয়েছিল এবং আদালত তার পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে ‘নারীর’ স্বাধীনতার প্রশ্নে বৈষম্য তুলে ধরেছে। তাছাড়া ভিডিওতে আমরা দেখেছিলাম, সেদিন নরসিংদীর রেলওয়েতে নারীর পোশাক ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, কটূক্তি করা হয়েছে, তাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। যা নারী নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ধারা ১০ মোতাবেক স্পষ্টই যৌন নিপীড়ন এবং ফৌজদারি অপরাধ। এই ফৌজদারি অপরাধকে অযাচিত বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

আমরাই পারি জোট উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত আইনজীবীর বক্তব্য অনুযায়ী আদালতের এই পর্যবেক্ষণ মুক্তিযুদ্ধ চেতনার পরিপন্থি এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষাধিক নারীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে নির্মিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা অত্যন্ত শঙ্কিত, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে এই ধরনের পর্যবেক্ষণ আগামীদিনে জনপরিসরে নারীর প্রতি নির্যাতনের ঘটনাকে পরোক্ষভাবে বৈধতা দান করে থাকবে। যা নারীর প্রতি নির্যাতনকে ভয়াবহ মাত্রায় নিয়ে যাবে।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন