করোনার কারণে স্মার্টফোন নির্ভর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হচ্ছে মানুষ: ড্যামন ইয়াং

 এম. মিজানুর রহমান সোহেল 
০৪ জুলাই ২০২০, ০৩:৩৮ এএম  |  অনলাইন সংস্করণ

মোবাইল হ্যান্ডসেট কোম্পানি অপো বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার পাঁচ বছর পার করলো। বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে অপো কতটা ব্যবসা সফল? আগামীদিনের পরিকল্পনাই বা কী? এই করোনাকালে মোবাইল ব্যবসায় কেমন প্রভাব পড়ছে? এমন নানান বিষয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন অপো বাংলাদেশ এইডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড্যামন ইয়াং। 

যুগান্তর: বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার পাঁচ বছর পূর্ণ করেছে অপো। এখানকার স্মার্টফোন বাজার নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

ড্যামন ইয়াং: গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারে বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে সরকারের প্রতিশ্রুতি এবং দেশে ফোরজি চালুর কারণে স্মার্টফোন শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটছে। ই-কমার্স, রাইড শেয়ারিং, অনলাইন ব্যাংকিং এবং মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের গ্রাহক বৃদ্ধির কারণে সাশ্রয়ী দামের স্মার্টফোনের চাহিদাও বাড়ছে। স্মার্টফোনের ব্যবহার বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণদের জীবনযাত্রা অনেক স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলছে। মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার সক্ষমতা রয়েছে স্মার্টফোনের, এমন বিশ্বাস নিয়ে আমরা গত বছর বাংলাদেশে সফল কার্যক্রমের পাঁচ বছর সম্পন্ন করেছি। স্মার্টফোনের ক্রমবর্ধমান চাহিদায় উৎসাহিত হয়ে আমরা এখানে সংযোজন কারখানাও স্থাপন করেছি। এর ফলে আমাদের স্মার্টফোন উৎপাদন খরচও কমেছে এবং আমরা দেশের মানুষের হাতে সাশ্রয়ী দামে স্মার্টফোন তুলে দিতে পারছি। এছাড়াও কারখানা স্থাপনের ফলে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ যেমন হয়েছে, তেমনি সরকারি কোষাগারেও অবদান রাখা সম্ভব হচ্ছে।

যুগান্তর: বাংলাদেশের স্মার্টফোন শিল্পে কোভিড-১৯ এর কেমন প্রভাব পড়েছে? 

ড্যামন ইয়াং: কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম সীমিত করতে বাধ্য হয়েছে এবং স্মার্টফোন বাজারও এর ব্যতিক্রম নয়। এ সময়ে স্মার্টফোনের যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ থাকায় স্মার্টফোন সংযোজনের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। তবে এই পরিস্থিতিতে কিছু নতুন সুযোগও তৈরি হচ্ছে। মোবাইল অপারেটরগুলো থেকে প্রাপ্ত সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা গেছে মহামারীর কারণে গ্রাহকদের মাঝে ডাটা ব্যবহারের প্রবণতা দ্বিগুণ হয়েছে। মেসেঞ্জার কিংবা ভিডিও কলের মাধ্যমে বন্ধু-পরিজনদের সঙ্গে যুক্ত থাকতে, ভিডিও স্ট্রিমিং কিংবা অনলাইন গেম খেলতে, সংবাদ পড়তে মানুষের মাঝে স্মার্টফোন ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে। সামাজিক দূরত্ব এবং কোয়ারেন্টিন বজায় রাখতে অনলাইনে গ্রোসারি সামগ্রী ক্রয়ের পাশাপাশি খাবার অর্ডার দিচ্ছে ব্যবহারকারীরা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানুষ এই জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে ভবিষ্যতে স্মার্টফোন বাজারের প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে। যদিও এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে কত সময় লাগবে সেটি বলা কঠিন। ব্যক্তিগতভাবে আমি সামনের দিনগুলো নিয়ে বেশ আশাবাদী। 

যুগান্তর: কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক স্মার্টফোন বাজার এবং বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারের মধ্যে আপনি কী ধরনের পার্থক্য দেখছেন?

ড্যামন ইয়াং: গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের মোবাইল ফোন বাজারের প্রবৃদ্ধি বেশ ভালো হলেও দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারী প্রায় ২৪ ভাগ। তুলনামূলকভাবে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের বাজারে স্মার্টফোন গ্রাহক প্রায় ৬০ শতাংশ। অপরদিকে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থাও প্রায় একইরকম, মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের প্রায় ২৫ ভাগ সেখানে স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। এই হিসাব থেকে বোঝা যাচ্ছে স্মার্টফোন গ্রাহক সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ এবং ভারতের বাজার এখনও অপরিণত। এর ইতিবাচক দিক হলো এখানে সম্ভাবনাও অনেক বেশি। ইতোমধ্যে থ্রিজি ও ফোরজি নেটওয়ার্ক চালু করার পাশাপাশি ফাইভজি নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশে সামনের দিনগুলোতে স্মার্টফোন বাজারের একটি বড় অগ্রগতি হবে। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবরূপ দিতেই আমরা এখানে স্মার্টফোন সংযোজন কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত হয়েছি। মহামারীর প্রভাব বিবেচনা করলে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ধরন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই হবে এবং আমরা এখানে ইতিবাচক কিছুই প্রত্যাশা করছি। 

যুগান্তর: এক্ষেত্রে আপনারা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন? কীভাবে এগুলো কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে আপনার মনে হয়?

ড্যামন ইয়াং: এখানকার বাজারে শক্ত প্রতিযোগিতা রয়েছে এবং গ্রাহকরা নিত্যনতুন উদ্ভাবন নিয়ে বেশ আগ্রহী। এ কারণে বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজার বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবে এই চ্যালেঞ্জ আমাদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক কারণ আমরা নিজেদের দক্ষতা এখানে তুলে ধরতে পারছি। এরই মধ্যে আমরা বেশ কিছু ডিভাইস এনেছি যা গ্রাহকদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এবং প্রতিযোগিতার কারণে আমরা এখানে সংযোজন কারখানা স্থাপন করেছি। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নে বাজারের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সরকারও মোবাইল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহায়তা করছে। মোবাইল বাজারের প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে টেলিযোগাযোগ সেবায় আরও সহনীয় শুল্ক কাঠামোর জন্য আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করছি। ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যে স্মার্টফোন গ্রাহক দ্বিগুণ হবে যা গ্রাম ও নগরের মানুষের আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্রের হার হ্রাসেও ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমরা মনে করি। স্মার্টফোনের কল্যাণকর দিকগুলো সবার সামনে তুলে ধরে সচেতন করার বিষয়টিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন বাস্তবায়নে পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চাইলে আমাদের অন্যান্য শিল্পকে প্রস্তুত করার পাশাপাশি কার্যকর ইকোসিস্টেম তৈরি করতে হবে। 

যুগান্তর: বর্তমান পরিস্থিতির প্রভাব থেকে উত্তরণে স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকার কীভাবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে বলে আপনি মনে করেন? 

ড্যামন ইয়াং: কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে স্মার্টফোন ইন্ডাস্ট্রিসহ সমাজের সকল অংশীজনদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত। সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাইজেশনের জন্য বাংলাদেশ একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করছে যা এই পরিস্থিতিতে দেশের সামগ্রিক অবস্থা পাল্টে দিতে পারে। যেহেতু মোবাইল ফোন ব্যবহার করে দেশের ৯০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয়, তাই ডিজিটাইজেশনের পদক্ষেপ সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে সহায়ক হবে।
সংক্রমিতদের শনাক্তকরণের মাধ্যমে সম্পদের কার্যকর বরাদ্দের সহায়তার পাশাপাশি কোভিড-১৯ কার্ভ নিম্নমুখী করতে সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে স্মার্টফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ইকোসিস্টেমের অন্যান্য অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করতে পারে। কোভিড-১৯ মোকাবেলার মাধ্যমে পরিবার-পরিজন ও প্রতিবেশীদের রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করতে অপো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশের নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে বাসা থেকে কাজ করতে আমরা কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেছি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কর্মস্থলে উপস্থিতি প্রয়োজনীয় হওয়ায় আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি যেন তারা নিজেদের মাঝে দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করতে পারেন। রিটেইল স্টোরের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা সরকারের সামাজিক দূরত্বের নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করছি। গ্রাহকদের বিভিন্ন অনুসন্ধানের তথ্য প্রদানে অপো অনলাইন সার্ভিস টিম নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের গ্রাহকদের জন্য আমরা বর্ধিত ওয়ারেন্টি প্রদান করেছি। 

যুগান্তর: বাংলাদেশের বাজার নিয়ে অপোর আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনা কী?

ড্যামন ইয়াং: বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ ভাগই তরুণ। সাধ্যের মধ্যে সাশ্রয়ী দামের স্মার্টফোন তুলে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের মধ্যে থাকা সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাই আমরা। ফাইভজির উন্নয়নেও বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে অপো। এর মধ্যে আছে ‘গ্র্যাভিটি প্লান ২.০’ নামে একটি সাপোর্ট প্রোগ্রাম যা ডেভেলপার ও পার্টনারদের সঙ্গে নিয়ে চালু করা হয়েছে। এছাড়া ফাইভ সিস্টেম-লেভেল ক্যাপাবিলিটি এক্সপোজার ইঞ্জিনস এবং আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ‘আইওটি অ্যানাবলমেন্ট প্লান’ হাতে নিয়েছে অপো। আগামী তিন বছরে গবেষণা ও উন্নয়নে (আরঅ্যান্ডডি) ৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে অপো। ফাইভজি, এআই, এআর, বিগ ডাটাসহ অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার এবং সিস্টেমের উন্নয়নে এই বিনিয়োগ কাজে লাগানো হবে। আরঅ্যান্ডডি থেকে প্রাপ্ত কিছু উদ্ভাবন এরই মধ্যে দেখা গেছে অপোর ফাইন্ড সিরিজ, রেনো সিরিজ, এফ সিরিজ এবং এ সিরিজের স্মার্টফোনে। বাংলাদেশ সরকার আগামী বছরের মধ্যে দেশে ফাইভজি নিয়ে আসতে কাজ করছে এবং আমরা বিশ্বাস করি অপো এই অগ্রযাত্রায় সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারবে।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন