মধ্যবিত্ত না মধ্যবৃত্ত পরিবার!

 মনোজ সরকার 
৩০ অক্টোবর ২০২২, ০৯:১২ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

নেট ঘাটতে ঘাটতে একটি কবিতার সামনে পড়ে গিয়েছিলাম। কী মনে করে পড়ে ফেললাম। শামীম বিন সাহেবের লেখা ‘আমি মধ্যবিত্ত’ কবিতাটি ভালো লেগে গেল। আর ভালো লাগবেই না কেন- এ তো আমাদের জীবনের বাস্তব রূপ।

‘চিত্তে নিত্য খেলা করে অবিরাম, শত কল্পনা।
মরুবাস্তবতায় মন আল্পনা আঁকে কত;
ধূলিঝড়ে মুছে যায় আবার, হয়ে যায় নিশ্চিহ্ন।

তিনচাকাওয়ালা রিকশা চলছে ঘোমটা দিয়ে,
আমার স্বপ্নগুলো জমেছে ওই ঘোমটায়,
পাশে বসা এক অর্ধাঙ্গী!
অপরূপা ওই সঙ্গী শুধুই স্বপ্ন, সে স্বপ্ন-
যত্ন করার সামর্থ্য আমার নেই।
বারেবারে ফিরে আসি তাই তপ্ত পিচে হাঁটায়!’

আসলেই তো আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার শুধু স্বপ্ন দেখতেই জানি। আর এই স্বপ্নকে আগলে ধরে চেষ্টা করি বেঁচে থাকার। স্বপ্ন আশায় জীবনকে গড়গড়ায়ে টেনে নিয়ে যায়। জীবনের সঙ্গে পাল্টে যায় স্বপ্নের ছবিগুলোও। অবশ্য আমাদের স্বপ্নগুলোও থাকে মধ্যবিত্ত স্বপ্ন। অবশ্য এটাকে মধ্যবিত্ত না বলে ‘মধ্যবৃত্ত’ বলাই ভালো।

স্বপ্ন আমার বাবাও দেখেছেন; তার বাবা, তারও বাবা দেখেছেন। আর বংশ পরম্পরায় পাওয়া এই স্বপ্নগুলো অনেক যত্নে লালন করে চলেছি যুগের পর যুগ ধরে। এই ‘মধ্যবৃত্ত’ স্বপ্নদের আঁকড়ে ধরেই বহমান আমাদের এই জীবন নদীর ধারা।

আর কে কী বলে জানি না; আমার কাছে জীবন মানে হলো বেঁচে থাকার এক নিরন্তর লড়াই। আর এ লড়াইয়ের ওপরই নির্ভর করে বাঁচা/মরার খেলা। সব কিছুই কোনোরকমে চলে যায়। বিলাসজীবন কী? শুধু শুনেছি; কখনো চোখে দেখিনি, উপভোগ তো দূরের কথা। শুধু কল্পনার রাজ্যে নিরন্তর বিচরণ; ভাবতে ভাবতে হাওয়ায় মিলেয়ে যায়। আবার সেই বৃত্তের মাঝে এসেই ঘোরাঘুরি। সামর্থ্য নেই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে, অনেক স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে হয় মধ্যবিত্ত পরিবারের।

কল্পনারাজ্য বিচরণে কোনো টাকা-পয়সা লাগে না, সবকিছুই হয় বিনা পয়সায়। তাই আভিজাত্যের মোহে হারিয়ে গেলেও টাকা কোথা থেকে আসছে সেই চিন্তা থাকে না। কিন্তু বাস্তবতায় বিলাসিতা দূরে থাক; সামান্য প্রয়োজনীয় কোনো কিছু চাইতেই যেন হাজারটা চিন্তা মাথায় মাথায় ঘুরপাক খায়। এরপরও মধ্যবিত্ত আভিজাত্য বজায় রাখতে মাঝে-মধ্যে অসাধ্য সাধন একেবারেই করা হয় না; তা নয়। তবে এর মাশুল গুনতে হয় পরিবারের সবাইকে এবং সেটা দীর্ঘমেয়াদি।

রিকশার বদলে বাস; অনেক সময় হেঁটেই কাজ চালিয়ে নিতে হয়। নিজের স্বপ্নগুলো দুমড়েমুচড়ে পদব্রজে এগিয়ে যাওয়া। কমে যায় বাজার। খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করে- যা একবারে না হলেই নয়, তাই। বড় বড় ঢেঁকুর তুলে জানান দিতে হয়- এই বেশ ভালো আছি; খাচ্ছি-দাচ্ছি ঘুমাচ্ছি। টনটনে আত্মসম্মানে যেন আঘাত না লাগে। আর আত্মসম্মানই মধ্যবিত্তের একমাত্র অহমিকা।

জন্মের পরই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের মাথায় একটাই চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়- লেখাপড়া শেষ করে চাকরি, আয় রোজগার আর সংসারের হাল ধরার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তা না হলেই জীবন বৃথা। সেখানে উদ্যোক্তা কিংবা শিল্পপতির কোনো উল্লেখ থাকে না; সর্বোচ্চ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার পর্যন্ত থাকতে পারে- তবে স্বাধীন কিছু করার উৎসাহ মিলে না কোনোভাবেই। এটা করা যেন মধ্যবিত্তদের জন্য মহাপাপের সামিল।

মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েরা বংশপরম্পরায় পাওয়া নিজেদের স্বপ্নটাকে সন্তানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। তার বাবারাও এভাবেই তাদের মধ্যে স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। সেই স্বপ্ন এবার চাপিয়ে দেওয়া হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে। আর এভাবেই চক্রাকারে চলতে থাকে মধ্যবিত্ত (মধ্যবৃত্ত) জীবনচক্র।

সব শেষে টিএ সোলেমানের কথায় বলতে হয়-

উপহাসের মাত্রা দেখে লজ্জাতে হই লাল
মন অজানায় হাত ছুঁয়ে পাই অশ্রু ভেজা গান
প্রবোধ দিয়ে কল্পনারা যায় দিয়ে যায় আড়ি
বৃত্ত হিসেব কষে দেখি মধ্যমাতে বাড়ি।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন