বিশ্ব ওষুধ বাজারের গতি-প্রকৃতি এবং বাংলাদেশের করণীয়

 ড. মো. আবু জাফর সাদেক 
২১ নভেম্বর ২০২২, ০২:৩৫ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

গত এক দশকে বিশ্ববাজারে স্বাস্থ্য খাতের প্রায় সব বিভাগে ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি ছিল উল্লেখ করার মতো। বিশেষত এই সময়ে ওষুধের বাজার প্রায় দ্বিগুণ আকার ধারণ করেছে, যার বার্ষিক পরিমাণ প্রায় ১.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৫ বছর এ বাজার প্রায় ৫ শতাংশের অধিক হারে বৃদ্ধি পাবে।

উন্নত বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হ্রাস পাওয়া, বেশ কিছু মূল্যবান ওষুধের পেটেন্ট শেষ হওয়া, প্রচলিত ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইনের আধুনিকায়ন, মানুষের জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন, উচ্চপ্রযুক্তির আবির্ভাব, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রতি অতিমাত্রায় সতর্কতা প্রভৃতি বিষয় ওষুধের বাজারে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে, যা বাজারের অভ্যন্তরে বেশ পরিবর্তন আনলেও সামগ্রিকভাবে প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশ্ব ওষুধ বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই পুরো বাজারের প্রায় ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে আর তাদের পর পরই আছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশসমূহের জোট, যাদের নিয়ন্ত্রণে প্রায় ১৫ শতাংশ বাজার। এ তালিকায় জাপানের অবস্থান তৃতীয়, তাদের নিয়ন্ত্রণে প্রায় ১২ শতাংশ বাজার। চীন ও ভারত ওষুধ বাজারে তাদের উল্লেখযোগ্য ছাপ রাখলেও সংখ্যা বিবেচনায় উপরোল্লিখিত দেশসমূহের চাইতে একটু পিছিয়ে। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই মূলত নির্ভর করে কোন পথে যাবে বিশ্ব ওষুধ বাজার।

স্বাস্থ্য খাতের আরেকটি বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হলো— রোগের ধরন পরিবর্তন। ২০১০ সালে বিশ্বে ৬০ বছরের অধিক বয়সের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ১০ শতাংশ, যা ২০৫০ সালে হতে যাচ্ছে ২১ শতাংশ; অর্থাৎ বয়সভিত্তিক রোগসমূহ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্মৃতিভ্রম, হাঁপানি, হাড়ের সমস্যা, দৃষ্টিহ্রাস, ক্যানসার, বাত-ব্যথা, স্ট্রোক, কিডনির সমস্যা প্রভৃতি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। উপরোক্ত বিষয় অনুধাবন করে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো রাসায়নিক ওষুধের পরিবর্তে জৈবপ্রযুক্তির ওষুধের (বায়োলজকিস) গবেষণার প্রতি বিশেষ জোর দিয়েছে।

এসব ওষুধের পেছনে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করাতে সাফল্যও মিলেছে। বর্তমানে জৈবপ্রযুক্তির ওষুধ (বায়োলজকিস)) ইনস্যুলিন ও ভ্যাকসিনে সীমাবদ্ধ না থেকে চিকিৎসাবিদ্যার প্রতিটি বিভাগে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। রাসায়নিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও সাম্প্রতিক সময়ে জৈবপ্রযুক্তির ওষুধের সহজলভ্যতার কারণে জৈবপ্রযুক্তির ওষুধের প্রতি বিশেষ আগ্রহ তৈরি করছে।

ওষুধসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে অল্প কিছুদিনের মধ্যে জৈবপ্রযুক্তির ওষুধের (বায়োলজকিস) বাজার রাসায়নিক ওষুধের বাজারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, এই সালে আর্থিক মূল্যে সবচাইতে বড় ২০টি ওষুধের অর্ধেকের বেশি হবে জৈবপ্রযুক্তির ওষুধ (বায়োলজকিস)। গত ৫ বছরে বিশ্বে প্রায় ১০০টি জৈবপ্রযুক্তির ওষুধ (বায়োলজকিস) স্বীকৃতি লাভ করেছে, তৎসঙ্গে গবেষণায় আছে আরও ৬০০টি জৈবপ্রযুক্তির ওষুধ (বায়োলজকিস) এবং ৩৭০টি জৈবপ্রযুক্তির ওষুধ (বায়োলজকিস) আবিষ্কার শেষে মানুষের ওপর বিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।

২০১০ সালের পরবর্তী সময়ে জৈবপ্রযুক্তির ওষুধের বাজারের (বায়োলজকিস) প্রবৃদ্ধি ছিল ১০০ শতাংশের ওপরে, যা অতীত ইতিহাসে বিরল। প্রতিটি জৈবপ্রযুক্তির (মূল/অরিজিনাল বায়োলজকিস) ওষুধের উদ্ভাবনী ব্যয় ৮০০ মিলিয়ন হতে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা শুধু উন্নত দেশের ওষুধ কোম্পানির পক্ষেই নির্বাহ করা সম্ভব। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অনেক কোম্পানি বিকল্প পথে হেঁটেছে, যা সাফল্যও পেয়েছে। বিকল্প এই পথটি হলো— মূল জৈবপ্রযুক্তির ওষুধের (মূল/অরিজিনাল বায়োলজকিস) সাদৃশ্যপূর্ণ জৈবপ্রযুক্তির ওষুধ (বায়োসিমিলার)।

সাদৃশ্যপূর্ণ জৈবপ্রযুক্তির (বায়োসিমিলার) ওষুধের গঠন মূল জৈবপ্রযুক্তির ওষুধের (অরিজিনাল বায়োলজকিস) সঙ্গে অতিসামঞ্জস্যপূর্ণ, যা মূল জৈবপ্রযুক্তির ওষুধের মতোই কাজ দেয়। মূল জৈবপ্রযুক্তির (অরিজিনাল বায়োলজকিস) ওষুধের পেটেন্ট শেষ হয়ে গেলে সাদৃশ্যপূর্ণ জৈবপ্রযুক্তির ওষুধ (বায়োসিমিলার) বাজারজাত করা যায়। এসব ওষুধের উদ্ভাবনী ব্যয় মূল জৈবপ্রযুক্তির (অরিজিনাল বায়োলজকিস) ওষুধের উদ্ভাবনী ব্যায়ের প্রায় এক দশমাংশ, যা অনেক কোম্পানির পক্ষে নির্বাহ করা সম্ভব।

সাদৃশ্যপূর্ণ জৈবপ্রযুক্তির ওষুধ (বায়োসিমিলার) ওষুধ নিয়ে উন্নত বিশ্বে  নানামুখী  আলোচনার কারণে অনেক ভেবেচিন্তে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (ইউএসএফডিএ) অনানুষ্ঠানিকভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ জৈবপ্রযুক্তির ওষুধ (বায়োসিমিলার) বাজারজাতকরণের অনুমতি দিয়েছে।

অনুমতিপ্রাপ্ত প্রথম জৈবপ্রযুক্তির সাদৃশ্যপূর্ণ (বায়োসিমিলার) ওষুধটি হলো ফিলগ্রাসটিম। স্যান্ডোজ ফার্মার এ ওষুধটি ক্যানসার থেরাপির কারণে ইমিউনিটি দুর্বল হয়ে গেলে তা বাড়াতে সহায়তা করে। মূল জৈবপ্রযুক্তির (অরিজিনাল বায়োলজিকস) ও জৈবপ্রযুক্তির সাদৃশ্যপূর্ণ (বায়োসিমিলার) ওষুধের পার্থক্য বোঝানোর জন্য মূল জৈবপ্রযুক্তির (অরিজিনাল বায়োলজিকস) ওষুধের নামের শেষে হাইফেন দিয়ে ৪ অক্ষরের অন্য কিছু যোগ করার বিধান করা হয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে, আগামী ২০২৪ সালের মধ্যে জৈবপ্রযুক্তির সাদৃশ্যপূর্ণ (বায়োসিমিলার) ওষুধ ব্যবহারের কারণে ৪৪.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস পাবে। 

জৈবপ্রযুক্তির সাদৃশ্যপূর্ণ (বায়োসিমিলার) ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সবচেয়ে ভালো স্থান এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশসমূহ। কারণ এখানে ওষুধ আইন অপেক্ষাকৃত শিথিল। এই বিষয়টি বিবেচনায় অনেক বহুজাতিক কোম্পানি উন্নয়নশীল দেশসমূহে জৈবপ্রযুক্তির সাদৃশ্যপূর্ণ (বায়োসিমিলার) ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের প্রতি বিশেষ জোর দিচ্ছে এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে কাজ করে চলছে।

ভারত ও চীন ইতোমধ্যে এ খাতে অবিশ্বাস্য রকমের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে উদ্যেক্তাদের নানাভাবে উৎসাহিত করছে। গত কয়েক বছরে ভারত সরকার ৫০টি জৈবপ্রযুক্তির ওষুধ বিপণনের অনুমতি দিয়েছে, যার ৫০ শতাংশই জৈবপ্রযুক্তির সাদৃশ্যপূর্ণ (বায়োসিমিলার) ।

বাংলাদেশে জৈবপ্রযুক্তির সাদৃশ্যপূর্ণ ওষুধের বাজার আনুমানিক ১৫০০ কোটি টাকার ওপরে, যার বেশিরভাগজুড়ে আছে ইনস্যুলিন ও এন্টক্যানসার ওষুধ । বেশ কিছু কোম্পানি ইতোমধ্যে জৈবপ্রযুক্তির ওষুধ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। তবে এসব অর্জন একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের। বাংলাদেশে এখনো কাঁচামাল তৈরি বা মৌলিক গবেষণার তেমন কোনো ক্ষেত্র তৈরি হয়নি, যা জৈবপ্রযুক্তির ওষুধের দ্রুত প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এক বিরাট অন্তরায়। তাই সংশ্লিষ্ট সবার অতিদ্রুত মৌলিক গবেষণার ওপর জোর দিয়ে নতুন জৈবপ্রযুক্তির/জৈবপ্রযুক্তির সাদৃশ্যপূর্ণ (বায়োসিমিলার) ওষুধ বা প্রচলিত কাঁচামাল তৈরির প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।

আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বেশ কিছু মূল জৈবপ্রযুক্তির (অরিজিনাল বায়োলজিকস) ওষুধের পেটেন্ট শেষ হয়ে যাচ্ছে, যেগুলোর বাজার বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল।

বাংলাদেশের উচিত এসব জৈবপ্রযুক্তির ওষুধের সাদৃশ্যপূর্ণ ওষুধের জন্য ব্যাপকভাবে কাজ করা, যাতে করে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে অনেক উচ্চপ্রযুক্তির ওষুধ বাজারজাত করা সম্ভব হবে তৎসঙ্গে বাড়বে রপ্তানির সম্ভাবনা। এ ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানিগুলোর গবেষণা সেল, আইসিডিডিআরবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদ, বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বায়োটেকনোলোজি ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি গবেষণা ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যারা নতুন ওষুধ আবিষ্কারের কাজ করবে। পুরো এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার জন্য পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) পদ্ধতিকে বেছে নেওয়া যেতে পারে।

এই গবেষণায় আবিষ্কৃত ওষুধের কাঁচামালের স্বত্ব থাকবে বাংলাদেশ সরকারের আর বানিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হবে মুন্সীগঞ্জের প্রস্তাবিত কাঁচামাল পার্কে অথবা সরকারনিয়ন্ত্রিত কোনো কারখানায়। পরে ওষুধ কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানির পরিবর্তে সরকারের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট দামে তা ক্রয় করে বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বিপণন করবে। এ ক্ষেত্রে যেসব কোম্পানি মৌলিক গবেষণায় বড় অঙ্কের অর্থ বা প্রযুক্তিগত সহায়তা করবে, তাদের জন্য বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিশেষ প্রয়োজনে বিদেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করা বাংলাদেশি ওষুধ বিজ্ঞানীদের সহায়তাও নেওয়া যেতে পারে নতুন ওষুধ তৈরি প্রক্রিয়ায়।

লেখক : ড. মো. আবু জাফর সাদেক
ফার্মাসিস্ট 
সহকারী মহাব্যবস্থাপক, ইউনিমেড ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ও
সাবেক খণ্ডকালীন পরামর্শক, বিশ্বব্যাংক, ঢাকা
 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন