সশস্ত্র বাহিনী দিবস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

 লে. কর্নেল ইমতিয়াজ মাহমুদ 
২১ নভেম্বর ২০২২, ০৬:৪২ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

জাতীয় জীবনে বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় ১৯৭১ সালের আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। হাজার বছরের শোষণ আর নির্যাতনের প্রতিবাদে নিজেদের অধিকার আদায়ে বীর বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে। আর এরই মাধ্যমে আমরা পাই আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা-জন্ম হয় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম হয় মহান এই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জল অধ্যায়ের মাধ্যমে। আজ সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক, জাতির এক আস্থার স্থান। 

১৯৭১ সালের পূর্বেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলার মানুষ সংগঠিত হতে থাকে এক পতাকাতলে। 

৭ মার্চ ১৯৭১, জাতির পিতার ঐন্দ্রজালিক ভাষণে রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস-বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথমদিকে যুদ্ধ শুরু হয় কিছুটা এলাকাভিত্তিক। কিন্তু ক্রমশই এই বিক্ষিপ্তযুদ্ধ সংগঠিত হতে থাকে। পাকিস্তান সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী হতে পালিয়ে আসা সদস্যদের সাথে যুক্ত হন আধাসামরিক বাহিনী ছাড়াও বাংলার সাধারণ জনগণ।

মুজিবনগর সরকার গঠনের পর এই প্রয়াস আরো গতিশীলতা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের সামরিক নেতৃত্বের একটি চেইন অব কমান্ড দৃশ্যমান হতে থাকে। সমগ্র রণক্ষেত্রকে ভাগ করা হয় ১১টি সেক্টরে যার নেতৃত্বে ছিলেন মূলত সামরিক বাহিনীর অফিসাররা। তাদের নেতৃত্বে সেক্টরগুলোতে শুরু হয় প্রতিরোধযুদ্ধ।  একই সাথে তিনটি ব্রিগেডের পাশাপাশি কিছু কিছু স্থানে গেরিলা বাহিনী সংগঠিত হয়ে স্থল যুদ্ধ শুরু করে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। মূলত সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকরা নিজেদের সংগঠিত করার পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীর পুনর্গঠনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। দিনের পর দিন বাংলার জনগণের অকুণ্ঠ সহায়তায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মুক্ত করে বাংলার বিভিন্ন এলাকা। তারা তৈরি করে বিজয়ের চূড়ান্ত মুহূর্ত।

প্রাথমিক পর্যায়ে স্থানীয় ও পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা নৌ ও বিমান সেনারা স্থল বাহিনীর সাথে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ শুরু করে।  ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুজিবনগর সরকারের উদ্যোগে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে ভারত সরকারের নিকট হতে দুটি টাগবোট সংগ্রহ করে গানবোটে রূপান্তরিত করা হয়। 

এ সময়ে নৌকমান্ডোদের দুঃসাহসিক অভিযান; অপারেশন জ্যাকপট; বিশ্বব্যাপী চাঞ্চল্য তৈরি করে। দেশের সংকটময় মুহূর্তে তৎকালীন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের বাঙালি পাইলট ও টেকনিশিয়ানরা বিভিন্নভাবে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।  পরবর্তীতে আসামের দুর্গম জঙ্গলে পরিত্যক্ত রানওয়েতে সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে শুরু হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর কার্যক্রম।

মুজিবনগর সরকারের সংগ্রহকরা একটি অটার প্লেন, একটি ডাকোটা বিমান আর একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারকে মেশিনগান ও রকেটে সজ্জিত করে শুরু হয় কিলো ফ্লাইটের যাত্রা। 

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর এলাকা ও চট্টগ্রাম তৈল শোধনাগারে বিমান হামলা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী।

নভেম্বর ১৯৭১ সালে সকল বাহিনীর সক্ষমতাকে সমন্বিত করে চলমান যুদ্ধে নতুন গতিশীলতা আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করে মুজিবনগর সরকার। 

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের এই দিনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সাথে মুক্তিকামী জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মিলিত আক্রমণের সূচনা করে। যদিও এর পূর্বেই তাদের নৈতিক পরাজয় হয়েছিল।  এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় উড়তে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা এবং ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত হয় আমাদের বিজয়।  যদিও মহান নেতা বহু আগেই বলেছিলেন- সাত কোটি মানুষকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।

আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।  জনগণেরএই সশস্ত্র বাহিনী বাংলার জনগণকে সাথে নিয়েই অর্জন করে বহু প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের পাশাপাশি জাতির পিতা একটি আধুনিক ও চৌকস বাহিনী গঠনের কাজ শুরু করেন। 

বিজয় অর্জনের সম্মিলিত প্রয়াসকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ২১ নভেম্বরকে একটি বিশেষ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। 

প্রকৃতপক্ষে সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সশস্ত্র বাহিনীকে এক অনন্য উচ্চতায় স্থান দিয়েছে। দেশের প্রয়োজনে সশস্ত্র বাহিনী সব সময় বাংলাদেশের জনগণের পাশে থেকেছে। ফোর্সেস গোল-২০৩০ এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে একটি আধুনিক সেনাবাহিনীতে রূপান্তর করা হচ্ছে এবং সেনাসদস্যদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতায় ও সেনাপ্রধানের দিক নির্দেশনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একটি প্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খলবাহিনী; যা জাতির গর্ব। উন্নতির একই ধারাবাহিকতায় নৌবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে সাবমেরিন। 

উন্নত নৌযানে সজ্জিত নৌবাহিনী সমুদ্রে আমাদের গর্বের প্রতীক। বিমানবাহিনীর অধুনিকায়নে তৈরি হয়েছে নতুন বিমানঘাঁটি। বিমান বহরে সংযোজন করা হয়েছে আধুনিক যুদ্ধবিমান। আজ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অবস্থান করে নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীর উন্নতির এ অগ্রযাত্রা আগত দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।

মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে আলোকিত সশস্ত্র বাহিনী দেশের প্রয়োজনে বহুবার নিয়োজিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছে।  পার্বত্য এলাকায় শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী উল্লেখযোগ্য ও কার্যকরী ভূমিকা রেখে চলেছে। এক্ষেত্রে বিমানবাহিনী ও পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি রক্ষায় সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছে।

এছাড়া বাংলাদেশকে প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়।  দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগোত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনীকে প্রথম নিয়োজিত করা হয়। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ও দুর্যোগ মোকাবেলার প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এ ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার মাধ্যমে অর্জন করেছে জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা।

একইভাবে সশস্ত্র বাহিনী শুধু দেশেই নয় দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে ও পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে চলেছে।  জাতিসংঘ শান্তি রক্ষাবাহিনীতে সদস্য প্রেরণে বাংলাদেশ আজ শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।  

পেশাদারিত্বে ও আন্তরিকতায় বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে যাচ্ছে। আজ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি সদস্য দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করছে। নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা, দেশপ্রেম, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, পেশাগত দক্ষতা এবং শৃঙ্খলার মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি সদস্য আজ অনুপ্রাণিত। 

দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় একটি পেশাদার ও আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর কোনো বিকল্প নেই। যদিও বিশ্বের অন্যতম শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে আমাদের পররাষ্ট্র নীতি হচ্ছে- সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়; তথাপি সুসজ্জিত ও আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর কোনো বিকল্প নেই।  বর্তমানে বাংলাদেশ এক অনন্য গতিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে সশস্ত্র বাহিনীকেও সামনে এগিয়ে যেতে হবে। লক্ষ্য অর্জনে সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই।

শান্তিকালীন তিন বাহিনীর সমন্বয় এবং যৌথ প্রশিক্ষণ তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মনে রাখতে হবে আধুনিক সরঞ্জাম দিয়েই নয়, আধুনিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের পেশাগত উন্নতিতে সক্রিয় হতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বুকে ধারণ করে ২১ নভেম্বরের চেতনায় সম্মিলিতভাবে দেশের অগ্রযাত্রায় শরিক হতে হবে।


লেখক: লে. কর্নেল ইমতিয়াজ মাহমুদ, বিএসপি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন