করোনায় চাকরি হারিয়ে সফল উদ্যোক্তা হলেন তারা

 রিনা আকতার তুলি 
০৯ জানুয়ারি ২০২১, ০৪:২৫ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

মহামারি করোনাভাইরাস পুরো পৃথিবীকেই ওলটপালট করে দিয়েছে। কেউ যা ভাবতে পারেনি, গত এক বছরে বিশ্বে তাই হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে একের পর এক লকডাউন দিতে বাধ্য হয়েছে বিভিন্ন দেশ। এর ব্যতিক্রম হয়নি বাংলাদেশেও। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। টানা লকডাউনে বন্ধ হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ মানুষের আয়-রোজগারের পথ। বেকার হতে হয়েছে বহু মানুষকে। বেঁচে থাকা নিয়ে চিন্তায় মানুষের ঘুম হারাম।

তবে এমন অব্স্থার মধ্যেও বেঁচে থাকার সংগ্রামে সফল হয়েছেন অনেকে। বেকারত্বের অভিশাপ মোচনে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, হয়েছেন উদ্যোক্তা। শুধু নিজেরই নয়, অন্যদেরও বাঁচার পথ দেখিয়েছেন।

করোনার এই কঠিন সময়ে চাকরি বা আয়-রোজগারের পথ হারিয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন- এমন ৪ জন একান্ত আলাপে যুগান্তরকে জানিয়েছেন করোনার এ সময়ে কঠিন পথচলা এবং তাদের স্বপ্ন ও সফলতার কথা।

জয়ন্ত বাড়ৈ

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত বছরের মার্চে সরকার দেশে লকডাউন দিতে বাধ্য হয়। তখন জয়ন্ত বাড়ৈ একটি কোম্পানিতে ভ্রমণ বিষয়ক কাজ করতেন। লকডাউনের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কোম্পানির আয় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এপ্রিল থেকে পুরো বেকার হয়ে যান জয়ন্ত।

কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ব্যবসার প্রতি তার ঝোঁক ছিল সব সময়। বিপদের এ সময়ে তাই তিনি লাইফস্টাইল প্রোবিডি ডটকম নামে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কসমেটিক্সের ব্যবসা শুরু করেন।

জয়ন্ত বাড়ৈ বলেন, লাইফস্টাইল প্রোবিডি ডটকম সাইটটি দেড় বছর আগে খোলা হয়েছিল। তবে বেকার হওয়ার পর ব্যবসার চিন্তা থেকেই পেইজটি নিয়ে কাজ করতে থাকি। বর্তমানে পেইজে ফলোয়ার আছেন ২৭ হাজারের বেশি।

কত টাকা পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুঁজি বলতে তেমন কিছুই না। মাত্র ৩৫শ’ টাকায় ব্যবসা শুরু করেছিলাম। ৮ মাস পর এখন আমার পুঁজি প্রায় ৩ লাখ টাকা। আর প্রতি মাসে আয়  হয় প্রায় ৩০-৪০ হাজার টাকা।

নবীন এই উদ্যোক্তা আরও বলেন, আমার সঙ্গে আরও দুইজন কাজ করেন। তবে অর্থের অভাবে ব্যবসা বড় করতে পারছি না। ব্যাংক লোনের চেষ্টা করেছি কিন্তু পাইনি। ব্যবসা বড় করতে পারলে আরও ৫-৬ জনের আয়ের ব্যবস্থা করতে পারব।

সরকারের একার পক্ষে এত বিশাল জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয় উল্লেখ করে জয়ন্ত বলেন, যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করে বের হচ্ছেন তাদের আমি বলব- ব্যবসা করার মনোভাব তৈরি করুন। এতে আপনি যেমন লাভবান হবেন, তেমনি আরও কয়েকজনের আয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। তাই পড়াশোনা শেষে চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করুন। এতে আপনিও ভালো থাকবেন, দেশও ভালো থাকবে।

জাহানারা বেগম

জাহানারা বেগম। করোনা মহামারি শুরুর আগে তিনি একটি সংবাদমাধ্যমে কাজ করতেন। জুন মাসে চাকরি হারিয়ে নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পরে অনেক ভেবেচিন্তে শুরু করেন মসলার ব্যবসা। সংসারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হচ্ছে মসলা, যা ছাড়া একদিনও চলা সম্ভব নয়। এ চিন্তা থেকে মসলার ব্যবসা শুরু করেন তিনি।

তিনি যুগান্তররে বলেন, আমরা ব্যবসা মূলত অনলাইনভিত্তিক। ৬ মাস হলো ব্যবসা করছি। হলুদ, মরিচ, ধনে গুঁড়োসহ সব ধনের মসলা বিক্রি করি। এগুলো প্রথমে বাজার থেকে কিনে আনি, এরপর রোদে শুকিয়ে নিজেরা গুঁড়ো করে বাজারজাত করি।

কেমন সাড়া পাচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি। পণ্যের গুণগতমান ঠিক রাখি ও কোনো রং বা প্রিজারভেটিভ মেশাই না।

জাহানারা বেগম বলেন, ৬ মাস হলো ব্যবসা করছি। অল্প পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করলেও এখন প্রতি মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকার মতো বিক্রি করছি। এ থেকে যে আয় হয় তাতে চাকরির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। চাকরি না করে আরও আগে এ ব্যবসা করতে পারলে বেশি লাভবান হতাম। চলতি মাসেও আমি ১০০ কেজি মসলা বিক্রি করেছি।

তিনি আরও বলেন, মনোহরি নামে একটি ফেসবুক পেইজ আছে আমার। এ পেইজের মাধ্যমেই মূলত আমার বিক্রি। এছাড়া পরিচিতদের মাধ্যমেও প্রচুর বিক্রি হয় পণ্যগুলো।

সাবিনা ইয়াসমিন মিথিলা

মিথিলা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। করোনার কারণে গত বছরের মে মাসে কোম্পানি তাকে বেতন না দিতে পেরে চাকরি থেকে বাদ দেয়। এরপর বসে না থেকে তিনি প্যাকেজিংয়ের ব্যবসা শুরু করেন। তার পণ্যগুলো হলো- কার্টন, জিপার ব্যাগ, ড্রেস প্যাকেটিং, টিস্যু ব্যাগ, হিমালয়ান পিংক সল্ট- যেগুলো মূলত পাকিস্তান, নেপাল ও ভারত থেকে আসে।

মিথিলা যুগান্তরকে বলেন, করোনার সময়ে বসে না থেকে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেই। এমন পণ্যের ব্যবসা করতে চাই যা অনেক দিন সংরক্ষণ করলেও পচে না। সেই চিন্তা থেকেই এ ব্যবসার চিন্তা মাথায় আসে।

তিনি বলেন, মাত্র ১ হাজার টাকায় ব্যবসা শুরু করি। এসএস ট্রেডিং নামে আমার একটি ই-কমার্স পেইজ আছে। এ পেইজের মাধ্যমেই বিক্রি করে থাকি।

ব্যবসার পুঁজি ও আয় কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকার মতো পণ্য বিক্রি করে থাকি। আয় ১৫ হাজার টাকার মতো। তবে পুঁজি কম বলে সীমিত পরিসরে ব্যবসা করতে হচ্ছে। অর্থিক সহযোগিতা পেলে ব্যবসা বড় করতে পারতাম।


তাসলিমা নিলু

মিরপুরের একটি স্কুলে চাকরি করতেন তাসলিমা নিলু। করোনার কারণে গত বছরের মার্চে স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত নেন উদ্যোক্তা হবেন। সেই চিন্তা থেকে তিনি এখন সফল ব্যবসায়ী।

‘সেলাইঘর’ নামে মিরপুর-১৩ নম্বরে একটি কাপড়ের দোকান রয়েছে তাসলিমা নিলুর। এছাড়া একই নামে বিজনেস পেইজও রয়েছে।

তাসলিমা নিলু যুগান্তরকে বলেন, বসে না থেকে কিছু একটা করতে চাচ্ছিলাম। সেই চিন্তা থেকে কাপড় সেলাই ও ব্যবসার চিন্তা মাথায় আসে। আমি আমার এখানে কাপড় সেলাই করি, ব্লক বাটিকের কাজ, থ্রিপিস, ছোটদের ড্রেস, ইন্ডিয়ান শাড়ি, কুর্তিসহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক বিক্রি করে থাকি। বর্তমানে আমার সঙ্গে ১৫ জনের মতো কাজ করছেন।

কত টাকা পুঁজিতে ব্যবসা শুরু করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুঁজি বলতে তেমন কিছুই নেই। মাত্র ১৭০ টাকায় ব্যবসা শুরু করি। ব্যবসার বয়স প্রায় ১ বছর হতে চলেছে। এখন পুঁজি প্রায় ৬ লাখ টাকার মতো। এছাড়া মাসে আয় ৮০ হাজার টাকার মতো।

তিনি আরও বলেন, আমি নারীদের উদ্দেশে বলতে চাই, আপনারা চাকরি না খুঁজে ব্যবসা করুন। এতে নিজে স্বাবলম্বী হবেন, অন্যকেও কাজের সুযোগ দিতে পারবেন।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন