ইউলিসিস

প্রথম অধ্যায় পঞ্চম কিস্তি
 মূল জেমস জয়েস অনুবাদ হারুন আল রশিদ 
১৭ জুন ২০২২, ১২:০০ এএম  |  অনলাইন সংস্করণ

দরজার কাছে কারও ছায়া পড়ে।

‘দুধ, জনাব!’

‘ভিতরে আসো, ম্যাডাম,’ মালিগান বলে। ‘কিন্চ, জগ নিয়ে আয়।’

বৃদ্ধা এগিয়ে এসে স্টিফেনের বাহুর পাশে দাঁড়ায়।

‘আহ, কী সুন্দর সকাল, স্যার,’ বৃদ্ধা বলে। ‘মহত্ব বিধাতার জন্য।’

‘কার জন্য?’ মালিগান বুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে। ‘আহ, ঠিক শুনেছি কি না তা নিশ্চিত হতে চেয়েছি!’

স্টিফেন আলমারিতে হাত ঢুকায় আর জগ বের করে আনে।

‘দ্বীপবাসিরা,’ মালিগান হ্যায়নেসকে আনমনে বলে, ‘প্রায়শই খতনার সময় কাটা অগ্রত্বক সংগ্রাহক গির্জাগুলো সম্বন্ধে আলোচনা করে।’

‘কতটুকু দিব, স্যার?’ বুড়ি জিজ্ঞেস করে।

‘এক পাইন্ট দেন,’ স্টিফেন বলে।

স্টিফেন তাকিয়ে থাকে। বুড়ি পরিমাপকের মধ্যে দুধ নিয়ে সেখান থেকে জগে ঢালে। ঘন, সাদা দুধ, যা বুড়ির নয়, স্টিফেন ভাবে, পুরোনো কুঁচকানো বোঁটা থেকে এই দুধ আসেনি। বুড়ি জগে আর একবার দুধ ঢালে; এইবার একটু বেশি দেয়। স্টিফেনের মনে আসে দেবী আথিনার কথা- তাফিয়ানস-এর রাজা মেন্টেস-এর ছদ্মবেশে-যে যুদ্ধে যাওয়া বীর অডিসিয়াসের অনুপস্থিতিতে তার ছেলে তেলেমাকাচকে সাবধান করতে এসেছিল। অডিসিয়াসের স্ত্রী, মানে তেলেমাকাচের মা, পেনেলপির প্রেমিকদের ব্যাপারে। বুড়ি দুধের স্বাস্থ্যগুণ বর্ণনা করে। স্টিফেনের চোখের ওপর ভেসে ওঠে সবুজ মাঠে সহিষ্ণু এক গাভীর পাশে বুড়ির ঘুপসি মেরে বসে থাকা রূপ, যেন ব্যাঙের ছাতার ওপর এক ডাইনি। বুড়ির কুঞ্চিত আঙুলের সচল টেপনে তাজা বাঁট থেকে ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসে দুধের ফোয়ারা। গবাদি পশুগুলোর গায়ের পশম শিশিরে ভেজা। তারা বুড়িকে চেনে আর তার কাছে এসে হাম্বা হাম্বা করে। অপূর্ব সুন্দর গবাদিপশুর দৃশ্য যা কিনা আয়ারল্যান্ডের অতীত রূপ; বুড়ি সবার চোখে এক হতভাগিনী, কিন্তু সত্যিকার দেশপ্রেমিকের চোখে এক চপলা বালিকা, যে রানির মতো হাঁটে। এককালে আয়ারল্যান্ডকে কত নামেই না ডাকা হতো। এ ভ্রাম্যমাণ বৃদ্ধা বিনয়ী, আর অমরতার প্রতীক, যে তার বিজেতা আর তার আমোদপ্রেমী বিশ্বাসঘাতককে সেবা দিয়ে যাচ্ছে; সে যেন তাদের স্ত্রী, অথচ তাদের যৌন-প্রতারণার শিকার। প্রজ্ঞা, চাতুর্য, আর যুদ্ধের দেবী আথিনার মতো বুড়ি হলো নেমে আসা সকালবেলার দেবদূত। উপকার করতে না তিরস্কার করতে, তা বলা মুশকিল। স্টিফেন এমন দেবদূতের আনুকূল্য অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করে।

‘চমৎকার জিনিস, ম্যাডাম,’ বাক মালিগান বলে, আর চায়ের কাপে দুধ ঢালে।

‘একটু খেয়ে দেখুন, স্যার,’ বুড়ি বলে।

মালিগান বুড়ির অনুরোধ রক্ষা করে।

‘আমরা যদি প্রতিদিন এ রকম ভালো জিনিস খেতে পেতাম,’ মালিগান কিছুটা উঁচু গলায় বলে, ‘তা হলে এ দেশ পচা দাঁত আর পচা আঁতে ভরে যেত না। আমাদের কপালে রয়েছে স্যাঁতসেঁতে ভাঙা ঘর, সস্তা পচা খাবার, ধুলো, ঘোড়ার মল, আর যক্ষ্মারোগীর থুতুতে ভরা রাস্তাঘাট।

‘আপনি কি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র, স্যার?’ বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করে।

‘হ, ম্যাডাম,’ বাক মালিগান উত্তর দেয়।

‘ওটা দেখুন,’ দুধওয়ালী বলে।

হিংসা হয় স্টিফেন এর-যার বিচরণের ক্ষেত্র শিল্পকলা-যখন সে দেখে বুড়ি ডাক্তার মালিগানকে বেশি সমীহ করে। মালিগান তার হাড্ডির চিকিৎসক, স্টিফেন ভাবে। বুড়ি তার জীর্ণ মাথা নত করে মালিগানের জোরালো কর্কশ আওয়াজ শুনে যায়। বুড়ির কাছে তা যেন পাদ্রির বাণী। যে বুড়ির সব পাপ ক্ষমা করবে, তার পুরো শরীরে তেল মালিশ করে তাকে কবরের জন্য প্রস্তুত করবে, কিন্তু তার গোপনাঙ্গ স্পর্শ করবে না, যা রজঃস্রাব আর প্রসবোত্তর রক্ত অপবিত্র করেছে। পুরুষের পাঁজর দিয়ে তাকে বানানো হলেও ঈশ্বরের চেহারা তাকে দেওয়া হয়নি। উপরন্তু তাকে সর্পবেশধারী শয়তানের প্রতারণার শিকার করা হয়েছে। নিষিদ্ধ ফল খেতে। স্টিফেন দেখে হ্যায়নেস উঁচু স্বরে আইরিশ ভাষায় বুড়ির সঙ্গে কথা বলে। হ্যায়নেসের বিস্মিত চঞ্চল চোখের সামনে বুড়ি চুপ মেরে যায়।

‘আপনি বুঝেছেন সে কী বলেছে?’ স্টিফেন বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করে।

‘ওটা কি ফরাসি ভাষা, স্যার?’ বুড়ি হ্যায়নেস-এর দিকে তাকিয়ে বলে।

হ্যায়নেস আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বুড়িকে এবার আরও এক দীর্ঘ বক্তৃতা শুনিয়ে দেয়।

‘সে তো আইরিশ বলেছে,’ বাক মালিগান বলে। ‘তুমি আইরিশ ভাষা জান না?’

‘শব্দগুলো আমার কাছে আইরিশই মনে হয়েছিল,’ বৃদ্ধা বলে। ‘স্যার, আপনার বাড়ি কি আয়ারল্যান্ডের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে। শুনেছি সেখানে এখনো আইরিশ ভাষায় কথা বলা হয়।’

‘আমি ইংরেজ,’ হ্যায়নেস উত্তর করে।

‘সে ইংরেজ,’ বাক মালিগান বলে, ‘আর সে মনে করে আয়ারল্যান্ডে আমাদের আইরিশ ভাষাই বলা উচিত।

‘অবশ্যই উচিত,’ বৃদ্ধা বলে। ‘আমি লজ্জিত যে আমি নিজেই ভাষাটা ভুলে গেছি। এ পূর্ব প্রান্তে ইংরেজি ছাড়া তো আর কিছু চলে না। তবে যারা আইরিশ জানে তারা আমাকে বলেছে সে এক মহান ভাষা।’

“মহান’ কথাটা ওটার বেলায় আর খাটে না,” বাক মালিগান বলে। ‘তবে সম্পূর্ণরূপে চমৎকার। আমাদের কাপে আরও চা ঢাল, কিন্চ। এক কাপ খাবে না কি, ম্যাডাম?’

‘না, অনেক ধন্যবাদ, স্যার,’ বৃদ্ধা বলে। দুধের কলসির আংটাটায় হাতের কব্জি প্রবেশ করিয়ে সে প্রস্থান করতে উদ্যত হয়।

হ্যায়নেস বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে বলে :

‘আপনার টাকা পেয়েছেন? ওনাকে দামটা দিয়ে দেওয়া উচিত, মালিগান, কী বল?’

স্টিফেন তিনটি কাপ আবার চা দিয়ে ভর্তি করে।

‘ও, দুধের দাম, স্যার,’ বুড়ি থেমে গিয়ে বলে। ‘আগের সাত দিন প্রতি সকালে এক পাইন্ট করে নিলেন। প্রতি পাইন্টের দাম দুই পেন্স। সুতরাং মোট দাম চৌদ্দ পেন্স, অর্থাৎ এক শিলিং দুই পেন্স। তারপর এ তিন সকালে প্রতিদিন নিয়েছেন এক কোয়ার্ট করে, প্রতি কোয়ার্টের দাম চার পেন্স। ফলে গত তিন দিনে হলো এক শিলিং। তার মানে দাঁড়ায়, স্যার, আপনারা দেবেন দুই শিলিং দুই পেন্স।’

বাক মালিগান দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মুখে মাখন মাখানো রুটি পুরে নেয়, তারপর ঠ্যাং দুটি সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে পায়জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে পয়সা খুঁজতে থাকে।

‘টাকাটা দাও ভাই, আর গোমড়া ভাবটা ত্যাগ করো,’ হ্যায়নেস হেসে বলে।

স্টিফেন তৃতীয়বারের মতো চা নেয়, আর তাতে দুধ আর চিনি মেশায়। চায়ের রং বদলায়। বাক মালিগান পকেট থেকে একটা ফ্লোরিন বের করে। ধাতব মুদ্রাটা সে আঙুলের মাথায় ঘোরায় আর চিৎকার করে বলে :

‘এটা অলৌকিক! না হলে কি আর এই অনীশ্বর সৌষ্ঠবহীন পয়সাটা আমার পকেটে পড়ে থাকত। এর মধ্যে তো রানির ছবিও নাই।’

মালিগান মুদ্রাটা টেবিলের ওপর দিয়ে বুড়ির দিকে ঠেলে দেয়।

‘আর চাইয়্যো না, মা-মণি,’ সে বলে। ‘এটা নাও, দুই শিলিং-এর সমান। এর বেশি আমার কাছে নাই।’ মালিগান সুইনবার্ন-এর ‘নৈবেদ্য’ কবিতা থেকে আবৃত্তি করে।

স্টিফেন মুদ্রাটা বৃদ্ধার অব্যাগ্র হাতের মধ্যে রাখে।

‘আপনার দুই পেন্স পাওনা রইল,’ স্টিফেন বলে।

‘অনেক বেলা হলো, স্যার,’ বৃদ্ধা মুদ্রাটা হাতে নিয়ে বলে। ‘অনেক বেলা। শুভ সকাল, ভদ্রমহোদয়গণ।’ বৃদ্ধা মাথা নত করে সৌজন্য প্রকাশ করে চলে যায়। বাক মালিগান কোমল কণ্ঠে একই কবিতা থেকে আবৃত্তি করতে থাকে :

হে আমার হৃদয়ের রানি, এ আর এমনকি,

একদিন রাখব তোমার পায়ে গ্রহ-তারকারাজি।

email : mharunalrashid73@gmail.com

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন