অধ্যাপক কায়কোবাদের সাক্ষাৎকার

বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং নিয়ে কথা বলার যোগ্যতাই রাখে না ঢাবি-বুয়েট

 আতাউর রহমান 
১৯ নভেম্বর ২০২২, ১২:০৭ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় এবারও উল্লেখযোগ্য অবস্থানে নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষার মানদণ্ডে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নতি দৃশ্যমান নয়। এ কারণে বিদেশি শিক্ষার্থীরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসে পড়তে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকরাও পাঠদান ও গবেষণায় এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। একাডেমিক এক্সচেঞ্জ না হওয়ায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বিশ্বমানের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।  

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডস (কিউএস) কিছু দিন আগে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। তাতে ৮০০-এর মধ্যেও স্থান হয়নি দেশের দুই সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)। টানা পঞ্চমবার কিউএস র‌্যাংকিংয়ে ৮০০-এর পর তথা ৮০১ থেকে ১০০০তম অবস্থানে রয়েছে দেশসেরা এ দুই বিশ্ববিদ্যালয়৷ 

অথচ ২০১৮ সালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই র‌্যাংকিংয়ে ৭০১-৭৫০তম অবস্থানে ছিল। দেড় যুগ আগে ছিল ৫০০-এর মধ্যে।
দিন দিন অবনতি ঘটলেও র‌্যাংকিংয়ের বিষয়টি গুরুত্বই দিচ্ছেন না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা। সম্প্রতি একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যদের কথায় সেটি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। 

যিনি একাডেমিক-গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়কে নেতৃত্ব দেবেন, সেই ভিসি নিয়োগ নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে। উপাচার্য নির্বাচনে স্বজনপ্রীতি, অস্বচ্ছতা ও কারও কারও ক্ষেত্রে একাডেমিক ও প্রশাসনিক যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আবার বরেণ্য শিক্ষাবিদদের অনেকে প্রশাসনিক এ দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহী। যেমনটি ফুটে উঠেছে খোদ শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কথায়। গত ২৯ মার্চ সংসদে দেওয়া বক্তৃতায় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, অনেক বরেণ্য শিক্ষক আছেন, যাদের উপাচার্য হিসেবে পেলে আমরা গর্ব অনুভব করতাম। কিন্তু তাদের অনেকেই এ প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে বরেণ্য শিক্ষাবিদদের অনাগ্রহ, র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে কথা হয় দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিরিয়ারিং ফ্যাকাল্টির সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. কায়কোবাদের সঙ্গে। তিনি দেশের সামগ্রিক উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি এবং শোধরানোর উপায় নিয়েও কথা বলেছেন।  দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথমটি আজ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো—

যুগান্তর : র‌্যাংকিংয়ে আমাদের অবস্থান এত পিছিয়ে কেন? 
কায়কোবাদ : আসলে আমি বলব— বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে আমাদের ভালো অবস্থানে থাকার কোনো কারণও নেই। কিউএস র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বসেরা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভারতের ৪৪টা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এমনকি শত সংকটকবলিত পাকিস্তানেরও ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পাকিস্তানের যেখানে ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে ভালো জায়গায় আছে, আর সেখানে আমাদের স্থানই নেই। আমাদের আর এ বিষয়ে কথা বলার মতো মুখই নেই।

যখন র‌্যাংকিং হয়, তখন আমরা বলে থাকি— এগুলো সঠিক নয়, আমাদের যোগ্যতার যথাযথ প্রতিফলন ঘটছে না এতে। এ কথা আমরা বলতে পারি না। এমআইটি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এমনটি বলতে পারে। তখন র‌্যাংকিং কর্তৃপক্ষ চিন্তা করবে কীভাবে হার্ভার্ড, এমআইটিকে র্যাংকিং প্রথার মধ্যে রাখা যায়। 

যুগান্তর : উচ্চশিক্ষায় গুণগত মানে উন্নতি করতে না পারার ক্ষেত্রে আমাদের মূল দুর্বলতাটা কোথায়?
কায়কোবাদ : মূলত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সুস্থ কোনো প্রতিযোগিতা নেই। আমাদের পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান— এমনকি শ্রীলংকাতেও নিজ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে র্যাংক করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নানাভাবে র্যাংক করা হয়। গবেষণায় কোন বিশ্ববিদ্যালয় ভালো, রসায়নে কারা ভালো, পদার্থে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ভালো, আন্ডারগ্র্যাজুয়েটে কারা ভালো। নানা রকমের সূচকে সেখানে র‌্যাংক করা হয়। এর ফলে তাদের নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকার প্রতিযোগিতা বা তাড়না কাজ করে। আমাদের কি এ ব্যবস্থা আছে? প্রতিযোগিতা আছে বলেই বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ওপরের দিকে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় কমপক্ষে ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের।

এবারও ১০০-তে ১০০ স্কোর নিয়ে প্রথম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে আছে যথাক্রমে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের পাশের দেশ ভারতেরও পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় সেরা ৩০০-তে স্থান পেয়েছে।

 

যুগান্তর : শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা না থাকাটাই কি পিছিয়ে পড়ার একমাত্র কারণ? 
কায়কোবাদ : দেখুন, নোবেল পদকের মতো একটা প্রতিযোগিতা যদি না থাকত, তবে এত মানুষ এই পদকের জন্য প্রতিযোগিতা করত না। আমি যখন স্কুলের ছাত্র ছিলাম, তখন আমার মতো হাজার হাজার ছাত্র স্বপ্ন দেখত কীভাবে ২০ জনের মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া যায়। মেধাতালিকায় কিন্তু ২০ জনের নাম উঠত, হাজার জনের নাম উঠত না। বাকিরাও কিন্তু কম ভালো ফল করত না। এটা হয়েছিল প্রতিযোগিতা থাকার কারণে। এখন আমরা সেই প্রতিযোগিতাটা বন্ধ করে দিয়েছি। 
এখন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে ১ লাখ ৬০ হাজার জিপিএ-৫ পায়। তাদের কারও সম্পর্কে বড় গলায় কথা বলা যায় না। কারণ এখানে প্রকৃত মেধার মূল্যায়নটা সঠিকভাবে হচ্ছে না।

যুগান্তর : সরকার তো শিক্ষাকে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছে। তবু কেন পরিবর্তনটা আসছে না?  
কায়কোবাদ : বাংলাদেশে ১৩-১৪টি শিক্ষা কমিশন হয়েছে, যার কোনোটির রিপোর্ট কিংবা নীতি আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। এখান থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না জাতি হিসেবে শিক্ষার প্রতি আমাদের অঙ্গীকার কতটুকু। তাছাড়া বলা হয়, শিক্ষায় জিডিপির ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া উচিত। আমরা তো তার ধারেকাছেও নেই। বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৪ সালে শিক্ষায় মোট বাজেটের ৪ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছিল। তার পর থেকে আমাদের বরাদ্দ কমে ২ শতাংশে নেমে এসেছে। 

যুগান্তর : বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ অপ্রতুল বলে আপনি মনে করেন? 
কায়কোবাদ : কিছু দিন আগেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প-হেকেপ হাতে নিয়েছিল। এতে সরকারের ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু র‌্যাংকিংয়ে তো এ বিনিয়োগের প্রতিফলন ঘটেনি।  তার মানে হচ্ছে বিনিয়োগ করলেই হবে না, সঠিকভাবে ব্যয় হয় কিনা সেটিও তদারকি করতে হবে। 

মূল কথা হচ্ছে— শিক্ষকরা গবেষণা ও শিক্ষায় যেন মন দেন সেটির জন্য প্রণোদনা দিতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ায় এই রকম উদাহরণ আছে— একজন শিক্ষক যদি ভালো জার্নালে পেপার প্রকাশ করতে পারেন, তাকে এক হাজার কিংবা দুই হাজার ডলার দেওয়া হতো। এই প্রণোদনার সুফল পেয়েছে দেশটি। যে কোরিয়ার ছাত্ররা একসময় আমাদের দেশে পড়তে আসত, এখন আমাদের ছাত্ররা সেখানে পড়তে যায়। আমাদের বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর নাম একসময় সবাই জানত। এখন আমাদের এমন কোনো বিজ্ঞানী নেই। এটি পীড়াদায়ক। 

আমরা যদি ঘোষণা করি শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী কিংবা গবেষককে ১০ কোটি টাকা পুরস্কার দেব। তা হলে নিশ্চয়ই হাজার হাজার জন চেষ্টা করবে। অনেকেই সমান মানের গবেষণা করবে। এতে কিন্তু বড় একটা অর্জন হয়ে যাবে। 

যুগান্তর : বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে অনেকেই পরে নোবেল পান। যেটি র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে রাখে। আমাদের তো সেই নজির খুব একটা নেই...।
কায়কোবাদ : আমি একটা অসাধারণ র‌্যাংকিংয়ের কথা উল্লেখ করব। আছে সেটি হচ্ছে— অ্যাকাডেমিক র‌্যাংকিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিস। সাংহাই-জিয়াটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হায়ার এডুকেশন প্রতিবছরই এই র‌্যাংকিং প্রকাশ করে।
এর মধ্যে যে সূচকগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়, তা হলো— কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পাশ করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কিনা, শিক্ষক-গবেষকরা নোবেল শান্তি পদক পেয়েছেন কিনা অথবা নাসা এবং সায়েন্স প্রকাশনা আছে কিনা। হাইলি সাইটেট অথরসের তালিকায় তাদের নাম আছে কিনা। এরকম কিছু সূচক আছে যেগুলো সরাসরি অর্থের উপর নির্ভর করে না। আমাদেরও ওই ধরনের র্যাংকিংয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। 

যুগান্তর : উচ্চশিক্ষায় ভালো করার উপায় কী?
কায়কোবাদ : আমরা বলে থাকি ভারত-চীন জনবহুল দেশ। ভারতের জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪০০-এর কম। চীনের জনঘনত্ব ১৫০ জন। আর আমাদের জনঘত্ব হচ্ছে ১২৫০। এই মানুষগুলোই আমাদের সম্পদ। সুতরাং সরকারকে কোনো জায়গায় যদি মূল্য সংযোজন করতে হয়, সেটি করতে হবে এই মানুষগুলোর শিক্ষায়। 

যুগান্তর: আপনাকে ধন্যবাদ।
কায়কোবাদ : আপনাকে ও যুগান্তরকে ধন্যবাদ।
 

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন