‘অভিবাসী নারীর অধিকার রক্ষায় স্থানীয় প্রতিনিধিদের সচেতনতা বাড়াতে হবে’

 যুগান্তর প্রতিবেদন 
২০ জুলাই ২০২২, ০৮:৩৫ পিএম  |  অনলাইন সংস্করণ

অভিবাসী নারী শ্রমিকরা যারা নির্যাতনের শিকার, নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরেছেন, তারা যে অর্থ সেখানে রেখে এসেছেন তা কিভাবে ফেরত পাওয়া যায় এর উদ্যোগ নিতে হবে।

একজন নারী অভিবাসী শ্রমিকও যেন আর নির্যাতনের শিকার না হয় তার অঙ্গীকার করতে হবে। দালালরা তাদেরকে বিদেশে গৃহপরিচারিকার কাজ দেওয়া নিয়ে যে কৌশল অবলম্বন করে তা থেকে নারী অভিবাসী শ্রমিকদের বের করে আনতে হবে। অভিবাসী নারীর অধিকার সুরক্ষায় স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করতে হবে।

ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তাদের অবগত থাকতে হবে তার এলাকার কে বা কারা অভিবাসী নারী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে কোন দেশে যাচ্ছেন, কার মাধ্যমে যাচ্ছেন। সিডব্লিউসিএস-এর আয়োজনে এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জ্বল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় নারী অভিবাসী শ্রমিকের অধিকার বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এ কথা বলেন।

সিডব্লিউসিএসের কোষাধ্যক্ষ নুসরাত সুলতানার সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইসিএমপিডির কান্ট্রি কোর্ডিনেটর মোহাম্মাদ ইকরাম হোসেন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদকে সম্পৃক্ত করে ইউনিয়ন পরিষদে নারী অভিবাসন কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। ডেমো অফিসকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং নারী-বান্ধব পরিবেশ প্রয়োজন। সরকারের বিভিন্ন সুবিধা আছে, সরকারের নতুন পলিসি উদ্যোগ নিচ্ছে যেমন রিইন্টিগ্রেশন পলিসি। একদম ডোর স্টেপে সার্ভিসগুলো প্রচার করতে হবে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কোর্ডিনেটর মহুয়া লেয়া ফলিয়া বলেন, গণমাধ্যমে বেশিরভাগ খবর নেতিবাচক। ইতিবাচক খবর কম দেখতে পাই। অভিবাসী নারীদের প্রতি শব্দ চয়নে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে তারা অসম্মানিতবোধ ও আঘাতপ্রাপ্ত না হয়। একটি শব্দ ভাণ্ডার তৈরি করার প্রস্তাবনাও দেন তিনি।

সিডব্লিউসিএস-এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ইশরাত শামীম বলেন, স্থানীয় সরকারকে অভিবাসনের সব তথ্য জানতে হবে। অভিবাসী নারীদের ডিজিটাল বিষয়ক শিক্ষা বাড়াতে হবে। দেশের বাইরে যাওয়ার আগেই তারা মোবাইল ফোনে ছবি তুলে কিভাবে তাদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস স্বজনদের কাছে পাঠাবেন, কিভাবে সংরক্ষণ করবেন তা শেখাতে হবে। তিনি আরও বলেন, সংবাদিকদের প্রতিবেদনে সম্পূর্ণ অভিবাসন খাতের তথ্য আনা জরুরি।

নারী অভিবাসী শ্রমিকের অধিকার বিষয়ক কিনোট পেপার উপস্থাপন করেন দৈনিক যুগান্তরের সাংবাদিক রীতা ভৌমিক।

সাংবাদিক রীতা ভৌমিক তার কিনোট পেপার উপস্থাপনায় তুলে ধরেন, নীতিনির্ধারক ও আইনজীবীদের উপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। যাতে নারী অভিবাসী শ্রমিকরা আর নির্যাতিত না হয়। নারী অভিবাসী শ্রমিকদের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করা জরুরি। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় নারী অভিবাসী শ্রমিকদের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন বন্ধ করতে হবে, অভিবাসনে ইচ্ছুক নারী অভিবাসী শ্রমিকদের অভিবাসনের সব তথ্য সরবরাহ করতে হবে, অভিবাসী নারী শ্রমিকদের দেশ ও বিদেশে সব সেবা কেন্দ্র থেকে সব রকম সহযোগিতা সরবরাহ করা জরুরি, বিদেশ ফেরত অভিবাসী নারীদের স্থায়ী পুনর্বাসন ব্যবস্থা করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বিএমইটি স্ট্যাস্টিটিক ডাটা অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২২-এর মে পর্যন্ত ১০ লাখ ৫০ হাজার ৮১৯ জন নারী অভিবাসন করেছেন। এ সংখ্যক নারীর সবাই নির্যাতনের শিকার হয়নি। তার মধ্যে কিছু সংখ্যক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

তিনি আরো বলেন, ২০২১-এর জানুয়ারি থেকে ২০২২-এর জুন পর্যন্ত মিডিয়া স্ক্যানে জানা যায়, মিডিয়া বেশিরভাগ নেতিবাচক কেসগুলো উপস্থাপন করেছে। যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে বেশিরভাগ তাদেরই কেস স্টোরি। কিন্তু কিভাবে তারা যাবে, কোন সেবা কেন্দ্র থেকে কি ধরনের তথ্য পাবে, তা মিডিয়াতে কম প্রচার হয়। 

প্রথম আলোতে প্রকাশিত ১ মে’র প্রতিবেদনে জানা যায়, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের হিসাব মতে, গত তিন বছরে (২০-২২) সন্তান নিয়ে দেশে ফিরেছেন ১২ জন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফিরেছেন ৬৫ জন নারী। ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর রাতেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফেরেন এক বাংলাদেশি নারী কর্মী। মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় চার দিন বিমানবন্দরে থেকে ২৬ অক্টোবর তাকে উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরবে মারা গেছে ১৩ ও ১৪ বছরের দুই গৃহকর্মী। ২০২১ সালে ১৩ থেকে ২৪ বছরের তিন মেয়ে ও দুই শিশু ভারতের কারাগার থেকে বেনাপোল সীমান্ত হয়ে দেশে ফিরেছেন। তারা পাচারের শিকার হয়েছিল।

আমরা আশা করছি, এ প্রতিবেদনগুলো দেখে নীতি নির্ধারণকারীরা যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ নিবেন।

দেশে ফেরত আসা দুজন ভুক্তভোগীর একজন নবাবগঞ্জের কলাকোপার নারগিস আক্তার বলেন, জয়পাড়ার মনির নামে এক দালালের (আসল বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া) মাধ্যমে তিনি লেবানন যান। দালাল বিদেশ যাওয়া বাবদ ৫০ হাজার টাকা নেয়। তাকে লেবাননে এক বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ দেয়। সেখানে অনেক অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হন তিনি। সব নির্যাতন সহ্য করে ১ বছর কাজ করেন। পরে গৃহকর্তার দ্বারা অত্যাচার ও নির্যাতনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাওয়ায় সেখান থেকে তিনি পালিয়ে যান। তিনি সেই দেশের ভাষা জানতেন না। এমনকি তার পরিচিতও কেউ ছিলেন না। এক বাঙালি নারীর সহযোগিতায় তিনি একটি কাজ পান। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো কাজও পাননি। বাংলাদেশে তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ থাকায় তিনি দেশেও ফেরত আসতে চাননি। এভাবেই সেখানে কখনো কাজ পেলে কাজ করেছেন, কাজ না পেলে আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়েছেন। এভাবে নারগিস লেবাননে দিনের পর দিন অবস্থান করেন। ২০২০ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশে ফেরত আসেন। দেশে ফেরার পর তার প্রতিবেশী, পাড়ার লোকেরা তার সঙ্গে কথা বলেনি, অনেকে তাকে নিয়ে কটূক্তি করেছে। তিনি এ ব্যাপারে কোনো মামলা করেননি।

আরেক ভুক্তভোগী কেরানিগঞ্জের শুভড্যা ইউনিয়নের ইকুরিয়ার মোসা. বেবী আক্তার বলেন, বাড়ির পাশে এক দালালের মাধ্যমে তিনি গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদিতে যান। সৌদি যেতে তার খরচ হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। গৃহকর্তা তাকে খাবার দেয়নি, মারধর করত। ৩ দিন তাকে বাথরুমে আটকে রেখেছিল। একদিন সুযোগ মতো সেখান থেকে পালিয়ে যান। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছিলেন। সেখানে এক বাঙালির সঙ্গে তার দেখা হয়। সেই বাঙালি তাকে বাংলাদেশ দূতাবাসে যাওয়ার পরামর্শ দেন। শুধু তাই নয়, তাকে একটি গাড়িতে উঠিয়ে দূতাবাসে যেতেও সহযোগিতা করেন। তিনি ১৫ দিন দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। কিন্তু দেশে ফিরবেন বিমান ভাড়া নেই। বাংলাদেশ থেকে ২২ হাজার টাকা পাঠালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। দৈনিক যুগান্তর, দৈনিক ইত্তেফাক, ডেইলি স্টার, দৈনিক সমকাল, নিউ এড, বিজনেস স্ট্যান্ডার্স, অন লাইন এবং টেলিভিশন গণমাধ্যম কর্মীসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা আলোচনায় অংশ নেন।

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন