হজে যেতে মধ্যস্বত্বভোগী বর্জন করুন

 মুহাম্মদ জসিমুদ্দিন 
১৮ নভেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম  |  প্রিন্ট সংস্করণ

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় পর্যায়ে হজ ও ওমরাহ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক তিন দিনব্যাপী মেলা চলছে। হজকে কেন্দ্র করে অসাধু ব্যক্তিদের দৌরাত্ম্য ও মধ্যস্বত্বভোগী রোধ করা এবং হজ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য আদান-প্রদানসহ এ মেলার মাধ্যমে প্রযুক্তিনির্ভর হজ ব্যবস্থাপনা

সম্পর্কে হজযাত্রীদের অবগত করা হবে। সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনায় এজেন্সিগুলোর প্রস্তুতি পরিকল্পনা ও হাজিদের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন-মুহাম্মদ জসিমুদ্দিন

ইসলামে হজের গুরুত্ব অপরিসীম। হাদিসে হজকে সর্বোত্তম ইবাদত বলা হয়েছে। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। আল্লাহ ও রাসূলে বিশ্বাসী প্রত্যেক মুমিন অন্তত জীবনে একবার কালো গিলাফ আর সবুজ গম্বুজ ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন লালন করেন।

অত্যন্ত আফসোসের সঙ্গে বলতে হয়, এক শ্রেণির আসাধু হজ ব্যবসায়ীর লালসার শিকার হয়ে প্রতিবছর সরলমনা বহু মুসলমান নানা দুর্ভোগে পড়েন। সব রকমের বিড়ম্বনা এড়িয়ে কীভাবে সহজে পবিত্র হজব্রত পালন করা যায়-এ নিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন নীর ট্রাভেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হাব ঢাকা জোনের মেম্বার মাওলানা আবদুল গফফার।

তিনি বলেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক হজে যাওয়ার আগে সঠিক এজেন্সি নির্বাচন করতে পারে না। তারা সরাসরি এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ না করে এমন কারও সঙ্গে যোগাযোগ করে যিনি হয়তো এক-দুবার হজ করেছেন অথবা মধ্যস্বত্বভোগী। ফলে কখনো এমন হয় যে, এ মধ্যস্বত্বভোগী তার রেজিস্ট্রেশনই করেনি কিংবা তার কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। অথচ এদিকে হজযাত্রী হজে গমনের অপেক্ষায় বসে আছেন।

তা ছাড়া কখনো এমন হয় যে, হজযাত্রী অল্প অল্প করে টাকা জমা দিচ্ছেন আর মধ্যস্বত্বভোগী তা খরচ করে ফেলছেন। যে কারণে তিনি ব্যংকে বা এজেন্সির কাছে রেজিস্ট্রশন ফি জমা করতে পারছেন না। এ জন্য হজযাত্রীর উচিত, মাধ্যম এড়িয়ে সরাসরি এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করা।

হজ ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগীর জটিলতা এড়াতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন, হজে গমনের জন্য আপনাকে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে প্রি-রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন হওয়া মাত্রই মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন। ব্যাংকে এ কাজ সারতে সাকুল্যে সময় ব্যয় হবে ১৫ মিনিট। সরকারের এ উদ্যোগকে ধন্যবাদ জানাই।

আমার মতে সরকার যদি এমন একটি আইন করে যে, হজযাত্রী নিজ হাতে ব্যাংকে টাকা জমা করবেন এবং তিনি যে এজেন্সির মাধ্যমে যেতে চাচ্ছেন তার লাইসেন্স নম্বর দেবেন। টাকা জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি মেসেজ হজযাত্রীর কাছে এবং আরেকটি মেসেজ তার নির্বাচিত এজেন্সির কাছে পৌঁছে যাবে। এক্ষেত্রে হজযাত্রী শতভাগ শঙ্কামুক্ত থাকতে পারবেন।

কথা বলেছেন হাফেজ মাওলানা জাহিদ আলম। তিনি বাংলাদেশ এয়ার ট্রাভেল্সের স্বত্বাধিকারী ও হাব-এর কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য। এবারের হজ ও ওমরাহ মেলার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘অতীতে হজ ব্যবস্থাপনায় নানারকম ত্রুটি-বিচ্যুতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার ও হাব-এর প্রচেষ্টায় হজ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ও শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে।

বাংলাদেশে হজযাত্রীদের অধিকাংশই গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। কিন্তু বেশিরভাগ হজ ও ওমরাহ এজেন্সির প্রাতিষ্ঠানিক কাজকর্ম ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই এ মেলার মাধ্যমে হজ এজেন্সি সম্পর্কে সবাইকে পরিচয়ের ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়াই অন্যতম উদ্দেশ্য। আমরা দেখেছি, ইতঃপূর্বে বিমানবন্দরে বহু হাজির চোখের পানি ঝরেছে ফ্লাইট বাতিল হওয়ার কারেণ। কিন্তু এখন হাব ও ধর্ম মন্ত্রণালয় ঐক্যবদ্ধ হয়ে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

২২ সালের হজে আমরা রাত-দিন প্রচেষ্টা করে মাত্র ২৫ দিনে হজের সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করেছি, আলহামদুলিল্লাহ। এখনো অনেক অব্যবস্থাপনা রয়েছে, যেগুলো দূর করতে হবে। হাজিরা আল্লাহর ঘরের মেহমান। তাদের কষ্ট দেওয়া গুনাহের কাজ। হজযাত্রী মধ্যস্বত্বভোগী এড়িয়ে সরাসরি এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করলে এসব পেরেশানি অনেকাংশে কমে যাবে বলে আমি মনে করি।

কিছু সমস্যা আছে, যেগুলোর সমাধান কোনো এজেন্সির হাতে নেই। যেমন, কোনো কোনো হজযাত্রী সৌদি পৌঁছে লাগেজ খুঁজে পান না। বাংলাদেশ বিমানবন্দরে লেবারদের অবহেলায় কারও লাগেজ নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো আমাদের দেশের মান-মর্যাদা নষ্ট করে। এ জন্য সরকারের উচিত এসব সমস্যার সমাধান করা।

জাবালে নুর ট্রাভেল্স অ্যান্ড ট্যুরস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হাব-এর কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য মুফতি জুনায়েদ গোলজার বলেন, হাজিরা আল্লাহর মেহমান। এ জন্য প্রতিটি এজেন্সিই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাতে একজন হাজি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে হজ আদায় করতে পারেন। হজ মৌসুমে লাখ লাখ মানুষ একত্রিত হয়।

যার ফলে বিশেষ ক্ষেত্রে কিছু বিড়ম্বনা হওয়াই স্বাভাবিক। মিনা, আরাফা ও মুযদালিফায় গাড়ি ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ সৌদি সরকারের অধীনে। যে কারণে এসব বিষয়ে এজেন্সি বা বাংলাদেশ সরকারের কিছুই করার থাকে না। তবে কিছু এজেন্সি আছে যারা অধিক পরিমাণে হাজিদের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

যে কারণে তারা সেবার মান অক্ষুণ্ন রাখতে পারে না। মক্কা-মদিনায় হাজিরা মুয়াল্লিম বা এজেন্সি কর্তৃপক্ষকে খুঁজে পান না। তাদের সেবা করা, সুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখা এজেন্সির নৈতিক দায়িত্ব। আমি মনে করি, যেসব এজেন্সি হাজিদের সেবার মান ও তাদের সঙ্গে কৃত ওয়াদা রক্ষা করতে পারে না এবং দেশের মান-মর্যাদা বিনষ্ট করে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।

দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, কিছু অসাধুচক্র আছে এজেন্সির লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে হজ ব্যবসা করে। আমার কাছে এ রকম এজেন্সির তথ্য আছে-যাদের হাজিরা মিনায় এক ইঞ্চি জায়গাও পাননি। আরাফাতের ময়দানে বহু ছোটাছুটির পরও তাঁবুতে ঠাঁই মেলেনি তাদের।

গাইড তো দূরের কথা, নিরুপায় পরিস্থিতির মাঝেও দেখা পাননি এজেন্সির কোনো প্রতিনিধির। এসব কারণে হাজিরা প্রচণ্ড দুর্ভোগ আর অবর্ণনীয় যন্ত্রণার শিকার হন। ন্যূনতম সেবা তো দূরের কথা, হাজিদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা করে নামে-বেনামের অনেক হজ এজেন্সি। এ জন্য হজযাত্রীদের উচিত সতর্কতার সঙ্গে হজ এজেন্সি নির্বাচন করা।

কথা হয় দীর্ঘ বছর থেকে হজ পালনকরী আলহাজ হাফেজ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন আল্লাহর রহমতে আমি বহুবার হজ ও ওমরাহের সফর করেছি। হাজিদের সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন কাবার গিলাফ ধরে আল্লাহর কাছে কায়মনে দোয়া ও কালো পাথরে চুম্বন করে নিজেকে আল্লাহর রহমতে সিক্ত করা। কিন্তু কিছু অসৎ মানুষের ফাঁদে পড়ে তারা মক্কা-মদিনার পাক জমিনেও সীমাহীন দুর্ভোগের সম্মুখীন হন। এটা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এ জন্য সরকারের উচিত এসব স্বার্থান্ধ লোকদের আইনের আওতায় এনে হজ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু ও সুবিন্যস্ত করা।

লেখক : আলেম ও গণমাধ্যমকর্মী

যুগান্তর ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন